moskque lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগে মসজিদ ছিল মুসলমানদের যাবতীয় জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও খতিব ও ইমামরা সমবেত মুসল্লিদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দেন। মানুষকে ইসলামী অনুশাসন মানার প্রতি আহ্বান করেন। মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা, দ্বীন প্রচার-প্রসার ও দ্বীনি জ্ঞানচর্চার পবিত্র স্থান। হাদিসে এরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার এ মসজিদে আসে এবং শুধু ভালো কাজের জন্যই আসে, যা সে শিক্ষা করে বা শিক্ষা দেয়, সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো। আর যে এছাড়া অন্য কাজে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো, সে অন্যের জিনিসকে দেখে, অথচ ভোগ করতে পারে না।’ (মেশকাত : ৬৮৬)।

মসজিদ প্রতিষ্ঠার ফজিলত : মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা একটি পবিত্র কাজ। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন হজরত আদম (আ.)। মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য ওয়াকফ শর্ত। ওয়াকফ ছাড়া মসজিদ হয় না। মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর মসজিদগুলোকে আবাদ করে সেই, যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে।’ (সূরা তওবা : ১৮)।

হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত ওসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।’ (মেশকাত : ৬৪৫)। অন্য হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মহল্লায় মহল্লায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে এবং মসজিদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ও তাতে সুগন্ধি লাগাতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ (মেশকাত : ৬৬৪)। উল্লেখিত হাদিসে ‘মহল্লায় মহল্লায়’ শব্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেখানে লোকের বসতি রয়েছে সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করবে। তবে অপর কোনো মসজিদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যেন না হয়।’ (মেশকাত : ৬৬৪)।

মসজিদের আদব : মসজিদ একটি পবিত্র স্থান। এর মধ্যে শুধু মহান আল্লাহর ইবাদত করা হয়। মসজিদে সাধারণভাবে চলাফেরা করা যায় না। আল্লাহর ঘর মসজিদে প্রবেশ এবং তা থেকে বের হওয়ার জন্য অনেক আদব রয়েছে। একইভাবে ভেতরে অবস্থান করলেও বিশেষ বিশেষ আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। মসজিদে প্রবেশের সুন্নত পাঁচটি ১. বিসমিল্লাহ পড়া ২. দরুদ শরিফ পড়া ৩. অতঃপর এ দোয়া পড়া ‘আল্লাহুম মাফতাহলি আবওয়াবা রাহমাতিক’ ৪. মসজিদে ডান পা আগে রাখা ৫. মসজিদে প্রবেশ করে ইতিকাফের নিয়ত করা।

(ইবনে মাজাহ-১/৫৬, মেশকাত-১/৪৬, শামী ২/৪৪৩)। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সুন্নতগুলোÑ ১. বিসমিল্লাহ পড়া ২. দরুদ শরিফ পড়া ৩. অতঃপর এ দোয়া পড়া ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিনফাদলিক’ ৪. মসজিদের বাইরে বাম পা আগে রাখা ৫. অতঃপর প্রথমে ডান পায়ে জুতা পরা। তারপর বাম পায়ে পরা। (ইবনে মাজাহ ১/৫৬, তিরমিজি ১/৭১, ই’লাউস সুনান ১/৩২৩, মেশকাত ১/৪৬)।

মসজিদে নামাজ পড়ার ফজিলত : মসজিদে নামাজ পড়ার ফজিলত নিয়ে অনেক হাদিস রয়েছে। তবে প্রত্যেক মসজিদের সওয়াব একই রকম নয়। কারণ, মুসলিম সমাজে দুই ধরনের মসজিদ রয়েছে। জামে মসজিদ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইবাদতখানা (পাঞ্জেগানা মসজিদ)। এ ছাড়াও মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদে আকসার সওয়াবও পৃথক পৃথক দেয়া হয়। আবার মসজিদের বাইরে কোথাও নামাজ আদায় করলে তার সওয়াবের পরিমাণও আলাদা।

১. মসজিদে হারাম : ‘মসজিদে হারাম’ বলে কাবাগৃহসহ চারিদিক পরিবেষ্টিত মসজিদকে। এখানে ‘হারাম’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। এ মসজিদের মধ্যখানেই কাবাগৃহ অবস্থিত। মসজিদে হারামে এক নামাজ ১ লাখ নামাজের সমান।
২. মসজিদে আকসা : মসজিদে আকসার বিবরণ কোরআনুল কারিমে একাধিকবার এসেছে। নবীজি (সা.) মিরাজ রজনীতে সেখানে গমন করেন। রাসুল (সা.) বলেন, মসজিদে আকসার এক নামাজ ৫০ হাজার নামাজের সমান।
৩. মসজিদে নববি : মসজিদে নববি হলো ইসলামের  সোনালি যুগের সব কর্মকান্ডের প্রথম কেন্দ্র। এ মসজিদের এক নামাজ ৫০ হাজার নামাজের সমান। তবে অন্য একটি হাদিসে আছে যে, মসজিদে নববির এক নামাজ ১ হাজার নামাজের সমান। এ হাদিসটি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। (মেশকাত : ৬৪০)।
৪. জামে মসজিদ : মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববি ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে মুসলমানরা সমবেত হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা হলে তাকে জামে মসজিদ বলে। এ মসজিদের এক নামাজ ৫০০ নামাজের সমান।
৫. পাঞ্জেগানা মসজিদ : যে মসজিদে জুমার নামাজ ব্যতীত শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া হয়, তাকে পাঞ্জেগানা মসজিদ বলে। এ মসজিদের এক নামাজ ২৫ নামাজের সমান।
৬. ঘর বা দোকানে নামাজ পড়া : মসজিদের বাইরে ঘরে বা দোকান ইত্যাদি জায়গায় নামাজ আদায় করলে এক নামাজের পরিবর্তে এক নামাজের সমান সওয়াব দেয়া হবে। (মেশকাত : ৬৯৬)।

মসজিদে যে কাজ নিষিদ্ধ : মসজিদ মুসলমানদের কাছে ইবাদতের স্থান হিসেবে পরিচিত। এর পরও মসজিদে এমন কিছু কাজ হতে দেখা যায়, যা মসজিদের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়। তাই মসজিদের পবিত্রতার জন্য কোরআন-হাদিসের নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। পবিত্রতা নষ্ট হয় এমন কাজ থেকে মসজিদকে রক্ষা করতে হবে।
১. মসজিদে হারানো বস্তু তালাশ করা যাবে না। কারণ, মসজিদে দ্বীনের কথা বা কাজ ব্যতীত অন্য কথা বা কাজ করা নিষেধ। (মেশকাত : ৬৫৪)। ২. মসজিদে দুর্গন্ধময় কোনো জিনিস নিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। (মেশকাত : ৬৫৫)। ৩. মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। (মেশকাত : ৬৭৭)। ৪. মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে ও দুনিয়াবি কথাবার্তা বলা যাবে না। (মেশকাত : ৬৮৯)।

৫. মসজিদে অপরাধীর শাস্তি ও শাসন করা যাবে না (মেশকাত : ৬৭৯)। ৬. মসজিদে রাজনৈতিক মিটিং করা মসজিদের আদবের খেলাপ। (ফাতাওয়া রহিমিয়া ৬/১০৫)। ৭. মসজিদের ভেতরে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ একই স্থানে আদায় করার জন্য কোনো নামাজি লোক স্থান নির্দিষ্ট রাখতে পারবে না। যে যেখানে এসে প্রথমে স্থান নেবে, সেই সেখানে নামাজ আদায় করবে। একে অপরকে ওঠিয়ে বসা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার : ১/৬৩০)।

৮. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সম্পর্কে অথবা উপদেশমূলক যে কোনো কবিতা পাঠ করা বৈধ। এছাড়া অন্য কবিতা আবৃত্তি মাকরুহ। কিন্তু কবিতা পাঠে নামাজিদের ক্ষতি হতে পারবে না। (রদ্দুল মুহতার নং ১/৬১৯)। ৯. হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন মসজিদে হত্যাকারীর মৃত্যুদ- কার্যকর করতে এবং সেখানে কবিতা পাঠ করতে ও শাসন কায়েম করতে। (মেশকাত : ৬৭৯)।

লেখক : শিক্ষক, নাজিরহাট বড় মাদরাসা, চট্টগ্রাম