pmসাজিদ হাসান রাসেল, দেশ প্রতিক্ষণ:
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে হয়েছিল। তবে সেই রাষ্ট্র গড়ার সময় তিনি পাননি। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে একে একে কর্মসূচি হাতে নেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর যার সুফল বাংলাদেশের জনগণ পেতে শুরু  করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই সেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে।

এসব উন্নয়ন কর্মসূচি তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকারে পরিণত করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে শেখ হাসিনার কাঁধে। তার সময়েই বাংলাদেশ নিম্ন থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার সব সময় ৬ এর ওপর রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হার রেকর্ড ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরই চ্যালেঞ্জিং ইস্যু গুলোতে হাত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যে চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ফারাক্কায় ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পায়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে শেখ হাসিনা সরকার। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলে জিইয়ে থাকা আড়াই দশকের যুদ্ধাবস্থার অবসানের সূচনা হয়।

ওই মেয়াদেই যমুনা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ’৯৬-তে ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ বাতিল করে প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এরপর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৩ সালের প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ইতিমধ্যে এই বিচারে জামায়াতের পাঁচজনসহ শীর্ষ ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনেও তার সরকার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সারা বিশ্ব যখন আইএস আতঙ্কে, তখন বাংলাদেশ শীর্ষ জঙ্গিদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান।

ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। যে চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় হয়। দেশের অভ্যন্তরে সর্বক্ষেত্রেই এই সময়ে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

যোগাযোগ ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সব মহাসড়কই চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সরে যাওয়া সত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। রাজধানীতে নতুন নুতন ফ্লাইওভার তৈরি করা হচ্ছে। বাস্তবায়নাধীন রয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। গড়ে তোলা হয়েছে হাতিরঝিলের মতো  দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।

নারীর ক্ষমতায়নে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে নারী শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেনি পর্যন্ত অবৈতনিক ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। শুধু নারীদের নয়, শিক্ষাকে কর্মমুখী ও যুগোপযোগী করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুিিক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী প্রযুক্তি ব্যবহারে এক বিপ্লব ঘটেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, দুর্যোগ মোকাবিলা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি ব্যবহারে এখন সরকারি সেবা পাওয়া অনেক সহজ হয়েছে।

বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারের সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার তথ্য প্রাপ্তিকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। নাগরিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কমেছে হয়রানি। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আত্মনির্ভরশীল করতে যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের আওতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো এবং উন্নত জাতের বীজ ও সার ব্যবহারে উৎপাদন অভাবনীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে উন্নয়নের এই স্বীকৃতি হিসেবে এ পর্যন্ত ২১টি আন্তর্জাতিক পদক লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে এবার লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ তুলে ধরা হলো: প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে গ্রেট ব্রিটেনের ডান্ডি অ্যাবার্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডক্টর অব লিবারেল আর্টস’ ডিগ্রি, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মাণসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রিএবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ‘ফেলিক্স হুফে বইনি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শেখ হাসিনাকে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে।

২০০০ সালে ব্রাসেলসের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অনারিয়াস কসা’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের ইউনিভার্সিটি অব বার্ডিগ্রেপোট বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে ‘ডক্টরস অব হিউম্যান লেটার্স’ প্রদান করে।

২০০৫ সালের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তির পক্ষে অবদান রাখার জন্য শেখ হাসিনাকে পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি প্রদান করে।

২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শিশুমৃত্যু হ্রাসসংক্রান্ত এমডিজি-৪ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।

একই বছর আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অবদানের জন্য এসটি পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় অবদানের জন্য শেখ হাসিনা আইএনইএসসিও কর্তৃক ‘কালচারাল ডাইভারসিটি’ পদকে ভূষিত হন।

২০১৪ সালে নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’, জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) দরিদ্রতা, অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।

২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।