audit-lagoএইচ কে জনি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারেন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে অসত্য তথ্য উপস্থাপন নতুন কিছু নয়। বেশকিছু কোম্পানি ইন্টার্নাল অডিটের মাধ্যমে এ কারসাজি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিতেই অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা (ইন্টার্নাল অডিট) হিসাব ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

আর এ বিষয়টির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের হাতে থাকায় তাদের ইচ্ছানুযায়ী অডিট কমিটির কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে স্বেচ্ছাচারিতা, অস্বচ্ছতা ও কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশকিছু কোম্পানি লোকসানে জড়িয়ে পড়েছে। অথচ গত বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফায় ছিল। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে তাদের লোকসানে পড়া কিংবা অস্বাভাবিকহারে মুনাফা কমে যাওয়ার কারণ রয়েছে।

জানা গেছে, কোম্পানির কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিল করার জন্য দাখিলকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসান দেখায়। আর এ লোকসান দেখানোর উৎস বের হয় অভ্যন্তরীণ অডিটের মাধ্যমে। নিজেদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি দেখানো হয়।

সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বস্ত্র খাতের কোম্পানি স্কয়ার টেক্সটাইলের আর্থিক হিসাবে লুকোচুরির অভিযোগ ওঠেছে। কোম্পানির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে ব্যাপক গরমিল লক্ষ্য করা গেছে।

কোম্পানিটি চলতি বছর (জানুয়ারী ২০১৫ থেকে জুন ২০১৬) এ ১৮ মাসে প্রথম তিন প্রান্তিকে কনসোলিডেটেড ইপিএস দেখিয়েছে যথাক্রমে ১.২৫, ১.২২ ও ১.০৯ টাকা। অর্থাৎ প্রথম ৯ মাসে কনসোলিডেটেড ইপিএস দেখিয়েছে ৩.৭৩ টাকা।

যারা কোম্পানির আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করেন তাঁরা সবাই প্রত্যাশা করেছিলেন ১৮ মাসে প্রায় দিগুণের কাছাকাছি (৭ থেকে ৭.৫ টাকা) ইপিএস আসবে। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে কোম্পানিটি ১৮ মাসে মাত্র ৪.৫৭ টাকা ইপিএস দেখায়।

যে কোম্পানি প্রথম ৯ মাসে ৩.৭৩ টাকা আয় করেছে, সেই একই কোম্পানি শেষ ৯ মাসে মাত্র ০.৮৪ টাকা আয়ের খবর রীতিমত অবিশ্বাস্য। অথচ শেষ ৯ মাসে কোম্পানির উৎপাদন যেমন বন্ধ ছিল না, তেমনি সামগ্রিকভাবে দেশের পোষাক খাতেও কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি। তাই স্কায়ার টেক্সটাইলের প্রথম ৯ মাস ও শেষ ৯ মাসের আয়ের অবিশ্বাস্য পার্থক্য নিশ্চিতভাবেই ব্যাখ্যার দাবী রাখে।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোম্পানিটি কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ডিএসই বা বিএসইসি এর পক্ষ থেকেও ব্যাখ্যা দাবি করা হয়নি। পরিণতিতে অপ্রত্যাশিত কম ইপিএস আসায় ক্ষতির স্বীকার হয়েছেন স্কয়ার টেক্সটাইলের বিনিয়োগকারীরা।

অভিযোগ ওঠেছে, কারসাজি এখানেই শেষ হয়নি। কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে পূর্ন আর্থিক প্রতিবেদন (নিরিক্ষিত) প্রকাশিত হলে তথ্য লুকোচুরির আসল চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে কোম্পানির ১৮ মাসে আন-কনসোলিডেটেড ইপিএস ৪.৫৭ টাকা ও কনসোলিডেটেড ইপিএস দেখানো হয় ৭.০২ টাকা!

অর্থাৎ স্কয়ার টেক্সটাইল প্রথম তিন প্রান্তিকের কনসোলিডেটেড ইপিএস এর তথ্য বাজারে সরবরাহ করলেও শেষ প্রান্তিকে আন-কনসোলিডেটেড ইপিএসের তথ্য বাজারে সরবরাহ করে ২.৪৫ টাকা আয় গোপন করেছে।

বাজারে নিবন্ধিত অন্যান্য কোম্পানি যাদের সাবসিডিয়ারী অথবা অ্যাসোসিয়েট কোম্পানি রয়েছে তারা সকলেই চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদনে কনসোলিডেটেড ইপিএস প্রদর্শন করে আসছে। কিন্তু স্কয়ার টেক্সটাইল বছর শেষে শুধুমাত্র আন-কনসোলিডেটেড ইপিএস প্রদর্শন করেছে। যার মাধ্যমে ২.৪৫ টাকা আয় কম দেখানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে কয়েকজন অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কোম্পানির অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের দুর্নীতি চোখে পড়লেও নিরবে বসে থাকতে হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে তাদের আর্থিক অনিয়ম প্রস্তুতকৃত রিপোর্টে তুলে ধরা যায় না।

এভাবে তাদের কোন খাতে কিভাবে আর্থিক অনিয়ম ঘটে তা তদন্ত করা যায় না। আর এভাবেই বেশকিছু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দিব্যি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব কোম্পানির মূল আয় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সেগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে পারে। কারণ বিগত চার বছর ধরে পুঁজিবাজারে ক্রান্তিকাল অতিবাহিত হয়েছে।

কিন্তু এসব কোম্পানির ব্যবসায়িক আয় উৎসের সঙ্গে পুঁজিবাজারের সম্পর্ক নিতান্তই দুর্বল। তাই বিগত সালে দেশের এমন কোনো ঝড় বয়ে যায়নি যে তাদের লোকসানে গিয়ে ঠেকতে হবে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে।

এদিকে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করছেন, পুঁজিবাজার কারসাজি চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে কোম্পানিগুলোর এ রকম অযৌক্তিক আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। যাতে তারা এটিকে ইস্যু করে ফাঁয়দা লুটতে পারে।

তাই প্রতিটি কোম্পানির দাখিলকৃত আর্থিক প্রতিবেদন পুন:পরীক্ষা করা দরকার। এজন্য পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বিত উদ্যেগ নেয়া এখন সময়ের দাবি বলে তারা মনে করছেন।