mozaffar-lagoশহিদুল ইসলাম ও আরিফুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যবসায়িক মুনাফার উল্লম্ফন দেখিয়ে ২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বস্ত্র খাতের কোম্পানি মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। তালিকাভুক্তির পর মুনাফার উল্লম্ফন অব্যাহত থাকলেও সদ্য সমাপ্ত হিসাব বছরে শেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে। এদিকে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা কমেছে কোম্পানিটির। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তালিকাভুক্তির পর থেকে কোম্পানিটি ধারাবাহিক ভাবে স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির চলতি বছরেও মুনাফার ইতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কোম্পানিটিকে আগের সমপরিমানই ডিভিডেন্ড প্রদান করতে হতো। ফলে কোম্পানিটি ইচ্ছাকৃতভাবে মুনাফা কম দেখিয়েছে বলে আপতত মনে হচ্ছে।

তারা বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে অতিদ্রুত কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পুনঃনিরীক্ষনের জন্য অডিটর নিয়োগ করা উচিত। কারণ, এ কোম্পানিটির সাথে হাজারও বিনিয়োগকারীর ভাগ্য জড়িত।

জানা যায়, সদ্য সমাপ্ত হিসাব বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে লোকসানে ছিল মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং। এদিকে, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা কমেছে কোম্পানিটি।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে (জুলাই’১৫ থেকে মার্চ’১৬) শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছিল ১.৯২ টাকা। ওই সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ’১৬ শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছিল ০.৫০ টাকা। কিন্তু ৩০ জুন ২০১৬ সমাপ্ত অর্থ বছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ১.৭২ টাকা।

ইয়ার ইন্ডে তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় কমেছে ০.২০ টাকা। অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত হিসাববছরের এপ্রিল থেকে জুন’১৬ শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০.২০ টাকা।

mozaffar-1-yearঅনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকেও মুনাফা কমেছে। যার ফলে এ বুধবার দিনশেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ দর পতন হয়েছে।

প্রথম প্রান্তিকে মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ০.৪০ টাকা, শেয়ার প্রতিকার্যকরী নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ০.৯০ টাকা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস)হয়েছে ১৬.৭৩ টাকা।

এর আগের বছর একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় ছিল ০.৮৫ টাকা, এনওসিএফপিএস ছিলো ০.৪৬ টাকা এবং ৩০ জুন, ২০১৬ পর্যন্ত শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস)ছিল ১৬.৩২ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে০.৪৫ টাকা বা ৫২.৯৪ শতাংশ।

প্রসপেক্টাসের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ৩০ জুন ২০০৯ সমাপ্ত হিসাব বছরে মোজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের কর পরিশোধের পর মুনাফা হয়েছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪১ হাজার ১৮৭ টাকা। কিন্তু ৩০ জুন ২০১৬ সমাপ্ত অর্থ বছরে কোম্পানিটি ৬ কোটি ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৯১৩ টাকা মুনাফা দেখিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। যা তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানির সর্বোচ্চ মুনাফা। পাশাপাশি কোম্পানির  তালিকাভুক্তির পর মুনাফার উল্লম্ফন অব্যাহত ছিল কোম্পানিটির।

তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩০ জুন ২০১৩ সমাপ্ত অর্থ বছরের হিসাবানুযায়ী কোম্পানিটির টার্নওভার হয়েছিল ৮৫ কোটি ৫ লঅখ ১১ হাজার ২৩০ টাকা। যা ৩০ জুন ২০১৫ শেষে ৩৩.৩৮ শতাংশ বাড়ে ১১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৯ টাকায় পৌঁছায়।

কিন্তু ৩০ জুন ২০১৩ সমাপ্ত অর্থ বছরের কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছিল ৭ কোটি ২৪ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৫ টাকা এবং ৩০ জুন ২০১৫ সমাপ্ত অর্থ বছরে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার ২৭৪ টাকা। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৯ টাকা বা ১৪২.৮০ শতাংশ।

কিন্তু ৩০ জুন ২০১৪ সমাপ্ত অর্থ বছরের কোম্পানিটির কর পরিশোধের পর মুনাফা হয়েছিল ১৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯১ টাকা। ওই বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করে। কিন্তু ২০১৫ সালে কোম্পানিটির মুনাফার উল্লম্ফনেও কোম্পানিটির ডিভিডেন্ডর পরিমান কমেছে।
এ বিষয় বিনিয়োগকারী আবদুর রাজ্জাক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, গত ২৯ অক্টোবর কোম্পানিটির বোর্ড সভার তারিখ ঘোষণা করা হলেও হঠাৎ করেই কোম্পানিটি বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করে। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে কোন কারসাজি করবে।

তিনি আরো বলেন, কোম্পানিটির ঘোষিত এই প্রতিবেদনে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্থ করতে ইচ্ছেকৃত ভাবে মুনাফা কম দেখানো হয়েছে। নতুবা সর্বশেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসানে যাওয়ার কারণ কি?

রাজ্জাক বলেন, এজিএমে দালাল চক্রের মাধ্যমে এ প্রতিবেদন পাশ করিয়ে নেওয়া হবে, আমি বিএসইসির কাছে আবেদন করছি তারা যেন কোম্পানিটির কারসাজি খুজে বের করতে দ্রুত অডিটর নিয়োগ দেয়। নতুবা এই কোম্পানিটি সুহৃদ, ওয়েস্টার্ন মেরিন কিংবা ফ্যামিলি টেক্স লিমিটেডের মত বেওয়ারিশ কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে।

বিনিয়োগকারী মাজহারুল ইসলাম দেশ প্রতিক্ষনকে বলেন, কোম্পানিটির ইচ্ছাকৃত কারসাজিতে বুধবার কোম্পানিটির শেয়ারদর চলতি বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম অবস্থানে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে যদি কোম্পানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে আমাদের পথে বসতে হবে।

নাম প্রকাশে অনইচ্ছুক ডিএসইর একটি সিকিউরিটিজ হাউজের মালিক বলেন, সদ্য সমাপ্ত বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসানে যাওয়া রহস্য জনক। বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড করতে হবে এমন ভয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে লোকসান দেখিয়েছে। যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে যাচাই করে দেখা উচিত।

তিনি আরো বলেন, তালিকাভুক্তির পর প্রথম বছরে কোম্পানিটি ২৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করলেও চলতি বছরে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছর কোম্পানিটি নো ডিভিডেন্ডও ঘোষণা করতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।