medcialদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চরম নৈরাজ্য চলছে রাজধানীর অভিজাত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থায়। একের পর এক ভুল চিকিৎসা, রোগী হত্যা, অঙ্গহানি, চিকিৎসা খরচের নামে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া, লাশ আটকে রেখে টাকা আদায়সহ নানারকম হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে।

তবে অদৃশ্য কারণেই তা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। আর অভিজাত হাসপাতালগুলোর নির্দয় বাণিজ্যের কাছে বরাবরই হার মানছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা।

চিকিৎসকের ভুলে দিনের পর দিন অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবু দোষী চিকিৎসকের কিছু হয় না। ভুল চিকিৎসার শিকার বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিপূরণের কোনো অভিযোগ ছাড়াই চুপচাপ বাড়ি ফিরে যান। কোনো ছাত্রছাত্রী ভুল চিকিৎসায় মারা গেলে তাদের বন্ধুবান্ধব হাসপাতালে কিছু বিক্ষোভ করেন, তারপর সব চুপ। এছাড়া, ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে এ দেশে কোনো অনুসন্ধান হয় না, অভিযোগ হয় না, ক্ষতিপূরণের নজির নেই বললেই চলে।

রাজধানীর অভিজাত হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম ইউনাইটেড হাতপাতাল লিমিটেড। তবে এ হাসপাতালটিকে ঘিরে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন সময়ে ভুল চিকিৎসাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ ৭৮দিন দরে এ হাসপাতালটিতেই হার্টের চিকিৎসা চলছে ইসমত আরার (৪৫)।

এখানেই করা হয় তার হার্টের বাইপাস অপারেশন। তবে আজ পর্যন্ত তার চিকিৎসা শেষ হয়নি। হার্টে পানি জমছে এই অজুহাতে এ পর্যন্ত ছয়বার সেলাই কাঁটা হয়। এর মধ্যে আবার একটানা ২১দিন তাকে রাখা হয় সেলাই ছাড়া।

আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো- এ রোগীর ক্রিটেইনিন রিপোর্ট হলো ১.৭। তবে রিপোর্টে ক্রিটেইনিন লেখা হয় ৩.০৮। বিষয়টি নিয়ে রোগীর আত্মীয়-স্বজন চ্যালেঞ্জ করলে পুনরায় পরীক্ষা করে ক্রিটেইনিন দেখা যায় ১.৭। যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সেচ্ছাচারিতা ও অবোহেলার অন্যতম দৃষ্টান্ত বলেই মনে করেন রোগীর নিকট আত্মীয় জাফর হোসাইন।

তিনি দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ভালো চিকিৎসার আশায় রোগীকে নিয়ে এ হাসপাতালে এসেছিলাম। প্রায় তিন মাস হতে যাচ্ছে রোগী ভর্তি করিয়েছি। তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। অপারেশনের পরে ছয়বার সেলাই ওপেন করা হয়েছে, সেলাই ওপেন করা অবস্থায় রাখা হয়েছে তিন সপ্তাহ।

এ পর্যন্ত ব্লাড লেগেছে প্রায় ৫০ ব্যাগ। এখন দিন যতই গড়াচ্ছে রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। এদিকে দ্বায়িত্বে থাকা ডাক্তারও সঠিকভাবে কিছু বলছে না, তার কাছে পরামর্শ চাইলেও এড়িয়ে থাকছেন।

এ অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে একাদিক বার যোগাযোগ করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ আছে, চিকিৎসকরা রোগীদের কাছ থেকে কত টাকা নিতে পারেন, সেটাই মুখ্য; কত ওষুধ দিতে পারেন, তারই প্রতিযোগিতা। মৃত মানুষকে লাইফ সাপোর্টে রেখে মৃতের পরিবারকে কত বড় বিল ধরিয়ে দিতে পারেন, তারই যেন সাধনা চলছে। অভিজাত নামধারী হাতে গোনা কয়েকটি ‘তারকা’ হাসপাতাল বার বার নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও তাদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টুঁ-শব্দটি করার সাহস পায় না।

ধানমন্ডির এক অভিজাত হাসপাতালে ডাক্তারের অবহেলায় আবারও রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গুলশানের অন্য একটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে আরেক রোগী। বারিধারায় পাঁচ তারকা খ্যাত হাসপাতালটিতে মৃত শিশুর লাশ আটকে রেখে হাসপাতালের পাওনা টাকা আদায়ের ঘটনা আবারও ঘটেছে। কিন্তু কোনো ব্যাপারেই সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের বিন্দুমাত্র ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

ঢাকার পাঁচ তারকা খ্যাত অভিজাত হাসপাতালগুলোয় ডাক্তারদের কোনো বেতন নেই, আছে শুধু কমিশন। এ কমিশনকেই মাসিক বেতন হিসেবে ধরা হয়, কমিশনকে ধরা হয় বাণিজ্য হিসেবেও। হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে কমিশন, চিকিৎসায় কমিশন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন, লাইফ সাপোর্টে পাঠানো ও রাখায় কমিশন, ওষুধপথ্যে কমিশন, বিদেশে রোগী পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে মোটা অঙ্কের কমিশন।

হাসপাতালে রোগী পাঠানো থেকে লাশ হয়ে বের হওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলে বেপরোয়া কমিশন বাণিজ্যের শকট। আর এতসব কমিশন হাতানোর ধান্দাবাজি সার্থক করতেই রোগীদের মৃত্যুর পরও রেহাই মিলছে না। মৃত রোগীর লাশটিও বেমালুম লাইফ সাপোর্টে রেখে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা বিল হাতিয়ে নেওয়া হয়।

অভিজাত হাসপাতালগুলোয় ‘যত বিল তত কমিশন’ ভিত্তিতেই সন্তুষ্টচিত্ত ডাক্তারদের ভিড় জমে ওঠে। শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কমিশন হাতানো ডাক্তাররা পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলো ঘিরে মহাবাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। এ বাণিজ্যের প্রতারণা থেকে রোগী-স্বজন কারও নিস্তার নেই। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৪০ ভাগ ‘ভর্তি ফি’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে ঢোকে।

যিনি যত বেশি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন, ততই টাকা পাবেন তিনি। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার পান শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন। অন্যদিকে অত্যধিক ভাড়ার বেড-কেবিনে রোগী রাখার ক্ষেত্রেও ডাক্তারকে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন দেওয়ার নজির রয়েছে।

ফলে জীবিত রোগীকে ছলে-কৌশলে হাসপাতালে যেমন আটকে রাখা হয়, তেমনি রোগী মারা গেলেও তার লাশ কয়েক দিন পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে রেখে ‘অস্তিম বিল’ হাতিয়ে নেওয়ার ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।

নির্দয় বাণিজ্য : অভিজাত হাসপাতালগুলোয় লাইফ সাপোর্টের নামে চলছে অতি নির্দয় ঘৃণ্য ব্যবসা। কারণে-অকারণে রোগী নেওয়া হয় অস্তিম শয়ন সিটে। সাধারণত ফুসফুস, হৃদযন্ত্র বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করলে এ সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও হাঁচি-কাশি, জ্বরের রোগীকেও লাইফ সাপোর্টে পাঠানো হচ্ছে।

অপারেশনের রোগী হলে তো কথাই নেই। ছিঁচকে অপারেশনের রোগীকেও ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে বন্দী (!) রাখার বহু নজির রয়েছে। ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনদের কাছে লাইফ সাপোর্ট রীতিমতো আতঙ্কের নাম। লাইফ সাপোর্টকে রোগী ও স্বজনরা ‘রোগীদের জিম্মি রেখে মুক্তিপণ’ আদায় হিসেবে দেখছেন।

আবার একেক হাসপাতাল একেক ধরনের বিল আদায় করে নিচ্ছে। বারিধারার একটি অভিজাত হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের একটি সিট ভাড়া দিনে ৬ হাজার টাকা। তবে ভেন্টিলেটর, অক্সিজেনসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার বাবদ আলাদা বিল নেওয়া হয়।

এদিকে অভিজাত নামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা ফি আদায়েও সীমাহীন নৈরাজ্য চলে। রোগী ভর্তি ফি, শয্যার ভাড়া একেক হাসপাতালে একেক রকম। এখানে সরকারি নীতিমালা পাত্তা পায় না, মালিকদের ইচ্ছামতো তা আদায় চলছে।

শয্যার ভাড়া কোনোটিতে যদি দৈনিক ১ হাজার ৮০০ থেকে ৫ হাজার, অন্যটিতে ২ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫০০ কিংবা ২ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। শয্যা পেতে হাসপাতালের চাহিদামাফিক অগ্রিম টাকা দিয়ে তবেই সিট মেলে। হাসপাতালভেদে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফিও ভিন্ন।

আলট্রাসনোগ্রাম করাতে কোথাও নেয় ১ হাজার ২০০, আবার কোথাও নিচ্ছে ১ হাজার ৫০০ অথবা ১ হাজার ৩০০ টাকা। ইটিটি করতে এক জায়গায় নেয় ২ হাজার ২০০, অন্যত্র হয় ২ হাজার টাকা।

অথচ রাজধানীর সাধারণ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে লাগে ২০০ থেকে ৬০০ টাকা।বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকলেও তার তোয়াক্কা করছে না কেউ। নীতিমালায় উল্লেখ থাকা ফির তুলনায় শতগুণ, এমনকি কয়েক হাজার গুণ বেশি আদায়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ।

এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক সাংবাদিকদের জানান, পরিচালক (হাসপাতাল)-কে প্রধান করে গঠিত একটি টিম নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো পর্যবেক্ষণ করে।

বিভাগটিতে জনবল কম থাকায় প্রতি মাসে বা প্রতি ১৫ দিন অন্তর এত বিপুলসংখ্যক হাসপাতাল-ক্লিনিক পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক আরও জানান, দেশের কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।