imagesএইচ কে জনি : দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। ওই দিন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে ফ্লেক্সট্রেড সিস্টেমস নামে নতুন সফটওয়্যার চালু করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল উন্নত দেশের আদলে ট্রেডিং প্লাটফর্মে অটোমেশন ও বিনিয়োগকারীদের উন্নত সেবা প্রদান। কিন্তু যাত্রার শুরু থেকেই হোচট খায় ডিএসইর এই উদ্যোগ। বিশালাকারের অর্থ ব্যয় হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বরং বিনিয়োগকারীদের ভোগান্তি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিনিয়োগকারী ও ব্রোকার হাউজগুলোর লোকসানের পরিমাণ।

অভিযোগ রয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই ডিএসইর সফটওয়্যার ত্রুটির কারণে লোকসান গুনছে বেশিরভাগ ব্রোকার হাউজ। এছাড়া সার্ভারের ধীরগতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে লেনদেন সম্পন্ন না হ

ওয়ায় বিনিয়োগকারীরাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো দেড় লাখ হাওলা লেনদেন হওয়ার পরপরই সফটওয়্যারটি স্লো হয়ে যায়।

এছাড়া বাজারের মোট লেনদেন হাজার কোটির উপরে উঠলেই সফটওয়্যারে সমস্যা দেখা দেয়। লেনদেন নিষ্পত্তিতে ধীরগতি, যথাসময়ে অর্ডার এক্সিকিউট না হওয়াসহ সফটওয়্যারটিতে আরো বেশকিছু সমস্যা ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। আজ রোববারও বেশকিছু সিকিউরিটিজ হাউজে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর আগে গত বহস্পতিবারও প্রায় অর্ধশত সিকিউরিটিজ হাউজ লেনদেনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

জানা গেছে, আজ রোববার ও গত বৃহস্পতিবার লেনদেনের প্রথম ও শেষদিকে অর্ধশতাধিক ব্রোকারেজ হাউস পূর্ণ লেনদেনে অংশ নিতে পারেনি। এসব ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার কেনা গেলেও বিক্রি করা যাচ্ছিল না। ডিএসই কর্তৃপক্ষকে এ সমস্যার কথা জানায় ব্রোকারেজ হাউসগুলো। কিন্তু তাদের বাদ দিয়েই অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে লেনদেন শুরু করে ডিএসই। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক/সিইও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই আমরা এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। এ বিষয়ে ডিএসইকে একাধিকবার অবহিত করা হলেও এর কোন প্রতিকার মেলেনি। অবশ্য মাঝে মাঝে ডিএসইর পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এতে আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পূরণ কে করবে?

আমীনুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিএসইর সার্ভার স্লো থাকার কারণে আজ আমি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। একটা শেয়ার একাধিকবার সেল অর্ডার দেয়ার পরও সার্ভার স্লো থাকায় তা এক্সিকিউট হয় নাই। যার ফলে আমাকে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কমে শেয়ারটি বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি ডিএসই কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান তার এই লোকসানের দায় কে নেবে?

জানা গেছে, লেনদেন কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে ২০১৪ সালের ১০ই ডিসেম্বর ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নেক্সট জেনারেশন’ নামে নতুন ট্রেডিং সফটওয়্যারের উদ্বোধন করে ডিএসই। এটি সরবরাহ করেছে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নাসডাক। নতুন এ সফটওয়্যারে কারিগরি কোনো ত্রুটি নেই বলে ডিএসইর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. স্বপন কুমার বালা দাবি করেছিলেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ডিএসইর সফটওয়্যারটি স্থাপনের জন্য প্রায় ৩ বছর কাজ করতে হতো। কিন্তু এটি অত্যধিক চাপের মধ্যে থেকে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। অটোমেটেডে ট্রেডিং সিস্টেমে রিনিউয়াল প্রজেক্টে নামে ডিএসইর প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকার উপরে ব্যয় হয়েছে। আর্ন্তজাতিকভাবে পরিচিত প্রতিষ্ঠান নাসডাক এবং ফ্লেক্স ট্রেডের মাধ্যমে এ সফটওয়্যার আনা হয়। ডিএসইর ফ্লেক্সটিপি সফটওয়্যারের ৫টি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো : নেটওয়ার্ক কনফিগার, টার্মিনাল কনফিগার, ব্রোকার কনফিগার, ব্রোকার এডমিন অপারেশন, ক্রেডিট কন্ট্রোল অপারেশন এবং ডিএসই-ফ্লেক্সপিটি ডিলার অপারেশন (ভিউ অনলি)। প্রাথমিকভাবে ৩২ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে সার্ভার নেটওয়ার্কের ১৩ কোটি ৩৭ লাখ, নেটওয়ার্ক ইক্যুইপমেন্ট ৫ কোটি ৪২ লাখ, এএমসি নেটওয়ার্ক ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ডাটা সেন্টার ইক্যুইপমেন্ট ১ কোটি ৬৮ লাখ, টেষ্ট অ্যান্ড সাপোর্ট ৭৬ লাখ ৬০ হাজার, প্রশিক্ষণ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, রিকোয়্যারিং ইস্যু ৯ লাখ ৯৮ হাজার, লিগ্যাল ইস্যু ১৫ লাখ এবং অন্যান্য ৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়।

এদিকে রাত-দিন পরিশ্রম করে মাত্র ৯ মাসে সফটওয়্যার স্থাপন করার জন্য উৎসাহ ভাতা বাবদ এ বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের প্রায় ৭৫ লাখ টাকা দেয়া হয়।

জানা যায়, সম্প্রতি লেনদেন বেড়ে যাওয়ার পর থেকে ডিএসইর নতুন সফটওয়্যারে কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। বিশেষ করে লেনদেনের শেষ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে সফটওয়্যারটি ধীর হয়ে পড়ে। লেনদেন নিষ্পত্তিতে বিপত্তি দেখা দেয়। সমন্বয় করতে গিয়ে অনেক ব্রোকারেজ হাউস বিপাকে পড়ে। এ সমস্যাটি ডিএসই কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সফটওয়্যারটির আপডেটের কাজ চলছে। এতে কিছু সমস্যা হতে পারে। আপডেটের কাজ সম্পন্ন হলে সমস্যা থাকবে না। এর আগে ২০১২ সালের জুন মাসে ‘এমএসএ প্লাস’ নামে নতুন ট্রেডিং সফটওয়্যার চালু করেছিল ডিএসই। নতুন সফটওয়্যারটি চালুর পর থেকে নানা ধরনের বিপত্তির মুখে পড়তে হয় বিনিয়োগকারী ও ট্রেডারদের। লেনদেন নিষ্পত্তিতে ধীরগতি, যথাসময়ে অর্ডার এক্সিকিউট না হওয়াসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় সফটওয়্যারটিতে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় নতুন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরুর দিন। পরে নতুন কোম্পানির লেনদেন শুরুর কারণে সফটওয়্যারের ত্রুটি সমস্যার সমাধান হলেও পুরোপুরি তা থেকে মুক্ত হওয়া হতে পারেনি ডিএসই। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ ওরিয়ন ফার্মার লেনদেন শুরু হওয়ার দিন সফটওয়্যার জটিলতার কারণে কোম্পানিটির লেনদেন নিষ্পত্তিতে বড় ধরনের বিপাকে পড়তে হয় বিনিয়োগকারীদের। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে ওরিয়ন ফার্মার লেনদেন নিষ্পত্তিতে। ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর অ্যাপোলো ইস্পাতের লেনদেন শুরুর দিনও একই জটিলতার মধ্যে পড়তে হয় বিনিয়োগকারীদের। এতে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে অনেক বিনিয়োগকারী দাবি করেছেন। এছাড়া ২০১৪ সালের ১৩ই এপ্রিল ডিএসইর সার্ভার ত্রুটির কারণে শুরুর ৫ মিনিট পরই লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় ডিএসইর। পরে এমএসএ প্লাস নামে সফটওয়্যারের ত্রুটির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ‘এমএসএ প্লাস’ সফটওয়্যারের নানা ধরনের সমস্যার বিষয় তুলে ধরে।

প্রসঙ্গত, ‘ট্রেসা’ নামে ট্রেডিং সফটওয়্যার সংযোজনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৮ সালের ১০ই আগস্ট অটোমেটেড ট্রেডিং চালু করে ডিএসই।