Firstlead-Securitiesবিশেষ প্রতিবেদক : সিলেট মেট্রোসিটি সিকিউরিটিজের পর এবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেক হোল্ডার ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজ লিমিটেডে প্রায় ৩০০ জন বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিনিয়োগকারীদেরকে না জানিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা সমমূল্যের শেয়ার ও ইউনিট বিক্রি করা অর্থ হাউজ কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করেছে। এ বিষয়ে ওই হাউজ কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সেচেঞ্জে (সিএসই) অভিযোগ করা হলেও এখনো এর কোন সমাধান হয়নি। তবে সিএসইর পক্ষ থেকে দ্রুততম সময়ে এর সমাধান করা হবে বলে আশ্বাস দিলেও বরাবরই অর্থ ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন ভুক্তভুগী বিনিয়োগকারীরা। কারণ এর আগেও সিএসই’র অপর ট্রেক হোল্ডার মেট্রোসিটি সিকিউরিটিজে প্রায় ১২০০ বিনিয়োগকারীর অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। যার পুরোপুরি সমাধান এখনো করতে পারেনি সিএসই।

জানা গেছে, ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজ লিমিটেডের বিশ্বনাথ শাখায় ২৮৫ জন বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিওতে থাকা ২০ কোটি টাকা সমমূল্যের শেয়ার বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট শাখার বিনিয়োগকারীরা ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজের জিন্দাবাহারস্থ হেড অফিসে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোন সদুত্তর পাননি। পরবর্তীতে গত ২৬ জানুয়ারি বিনিয়োগকারীরা হাউজ কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু এতেও কাজ না হওয়ায় তারা গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটস্থ সিএসই’র অফিসেও লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু সিএসইও বিষয়টি সমাধানে তাদের কাছে পরপর দুইবারে ১ মাস সময় নেয়। একইসঙ্গে ওই বিনিয়োকারীদেরকে ডিপিএ সিক্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার দীর্ঘ দিন পেরুলেও সিএসই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আশার বানী ছাড়া আর কিছু শোনাতে পারেনি এবং ডিপিএ সিক্সও প্রদান করে নি।

জানতে চাইলে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারী আবদুল মজিদ জানান, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তিলতিল করে গড়া সঞ্চয় এনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিলাম। আজ তাও হারিয়েছি। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে আমার ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। সেটাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। হাউজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোন লাভ হয় নি। সিএসইও ৬ মাস সময় চায়। এখন আমরা কি করব?
আরেক বিনিয়োগকারী আবুল কালাম জানান, আমার দুই অ্যাকাউন্টে আট লাখ টাকার শেয়ার ছিল। এখন হাউজ কর্তৃপক্ষ বলছে আমার অ্যাকাউন্টে কোন শেয়ার নেই। এখন আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে আ: কুদ্দুস বলেন, হাউজ কর্তৃপক্ষ ছয় মাস সময় চেয়েছে। কিন্তু একদিনও সময় দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এ ঘটনাটি ঘটেছে। আমরা বিষয়টি দ্রুত সমাধানের দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিনু চৌধুরি বলেন, বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। এজন্য সংশ্লিষ্ট শাখা ম্যানেজারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড় কোটি টাকার একটি চেকও নেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক এই চেকটিকে ডিক্লাইন করেছে। এজন্য একটি মামলাও করা হয়েছে।

এখন বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি কিভাবে সমন্বয় করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগে আমরা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বসে ৬ মাস সময় নিয়েছিলাম। তবে সিএসইসি আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়েছে। আমরা এর জবাব দিচ্ছি।

তবে তার দেওয়া হিসাবের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ক্ষতির হিসেবে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। কারণ ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজে এমডি জানিয়েছেন সবমিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে। আর বিনিয়োগকারীরা বলছেন প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার জানান, এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ঠিক কত টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বর্তমানে সিএসই’র একটি টিম ওখানে কাজ করছে। তাছাড়া ওই হাউজটিকে মোটামোটি স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হয়েছে। হাউজটির ডিপি অপারেশন পাওয়ারও কমিয়ে আনা হয়েছে। সবমিলিয়ে সিএসই বিষয়টি সমাধানে খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে তিনি জানান।

এর আগে প্রায় তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া সিলেট মেট্রোসিটি সিকিউরিটিজ কেলেঙ্কারির সমাধান করতে পারেনি সিএসই। এখন ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজ কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও কি একইভাবে কালক্ষেপণ করা হবে কি-না জানতে চাইলে সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, না এক্ষেত্রে তা হবে না। বিষয়টি খুব দ্রুত সমাধান করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিএসইসিকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটা সিকিউরিটিজ হাউজের নেটওয়ার্ক থাকে ৫০ কোটি টাকা। আর সে ব্যবসা করে এক হাজার কোটি টাকা। এখন ওই হাউজ যদি সে টাকা মেরে দেয়, তারতো লোকসান হবে না। বরং ৯৫০ কোটি টাকা লাভ হবে। কাজেই ব্যাক্তিমালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার আওতায় আনতে হবে। হয়তো তাকে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে, নতুবা ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ গ্যারান্টি দিতে হবে। যেন হাউজ কর্তৃপক্ষের কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকলেও বিনিয়োগকারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এখন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসিকেই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে এখনো কোন অভিযোগ আসেনি। তবে যদি অবৈধভাবে কোন হাউজ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়, তবে বিএসইসির পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি আশ্বাস প্রদান করেন।

সিএসই’র কাছে করা বিনিয়োগকারীদের অভিযোগে বলা হয়েছে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজের বিশ্বনাথ শাখায় লেনদেন করছি। কিন্তু হঠাৎ করেই কিছুদিন ধরে আমরা কোন প্রকার লেনদেনে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এই মর্মে শেয়ার অফিস (ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজ লি:, বিশ্বনাথ লিংক অফিস) এর সাথে যোগাযোগ করলে অফিস কর্তৃপক্ষ জানায় যে, আমাদের একাউন্টে কোন শেয়ার নেই। আমাদের মধ্যে অনেকের ডিভিডেন্ড বিও অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। এমনকি অনেকগুলো অ্যাকাউন্টে নেগেটিভ ব্যালেন্স দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের বিও অ্যাকান্টের মাধ্যমে কোন শেয়ার বিক্রি করি নাই বা বিক্রির জন্য কাউকে মনোনিতও করি নাই। তথাপিও অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রয়কৃত শেয়ারগুলো জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের অবগত করা হয়নি।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আমাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজ কর্তৃপক্ষ জানায় যে, শেয়ার লেনদেন সংক্রান্ত ঝামেলা হয়েছে এবং সিলেট অফিসে যোগাযোগ করার কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমরা তাৎক্ষনিক বিষয়টি ফার্স্টলিড সিকিউরিটিজের হেড অফিসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর গত ২০ জানুয়ারি লিখিত অভিযোগ করি। কিন্তু হাউজ কর্তৃপক্ষ আজ অবধি আমাদের কোন সদুত্তর দেয়নি। এমতাবস্থায় আমাদের বিনিয়োগকৃত মূলধন নিয়ে আমরা চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।