BSEC_logo_banglanews2420170228221542এইচ কে জনি : অতীতের সব ধকল কাটিয়ে ওঠছে দেশের পুঁজিবাজার। ২০১০ সালের ধস পরবর্তী টানা মন্দায় বিনিয়োগকারীরা যখন বাজারের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং বাজারের সূচক ও লেনদেন তলানীতে এসে ঠেকেছিল তখনই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়ে ওঠেন সরকারসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারনী মহল। অর্থমন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্তা-ব্যক্তিদের আন্তরিক প্রচেষ্টার বলেই বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই সুবাদে প্রতিদিনই বাড়ছে সূচক ও গড় লেনদেনের পরিমাণ। এতে প্রায় সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বাজারে প্রবেশ করছেন। তবে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী এক গোষ্ঠি নিজেদের পকেট ভরছে। বিনিয়োগ করলে মুনাফা করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে একচেটিয়া ব্যবসা করা- এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও ডে-ট্রেডিংয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। যা বাজারকে দুর্বল ও অস্থিশীল করে তুলতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগই যেকোন স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অধিকাংশ বিনিয়োগকারীকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের চেয়ে ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। শেয়ার ম্যাচিউরড হলেই তা বিক্রি করে মুনাফা করতে আগ্রহী। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে লোকসান থাকা সত্বেও গুজবে কান দিয়ে এক কোম্পানির শেয়ার লোকসানে ছেড়ে ঢুকে পড়ছেন অন্য কোম্পানিতে। এতে পুঁজিবাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।

একাধিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই বেশি দিন শেয়ার ধরে রাখতে চান না। তারা স্বল্পমেয়াদে অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করেন। সেজন্য তারা প্রতিনিয়ত পোর্টফোলিওতে পরিবর্তন আনছেন। বিশেষ করে তারা প্রতিদিনই নতুন নতুন খবরের অপেক্ষায় থাকে। কোন কোম্পানির শেয়ারদর বাড়বে এমনটি জানতে পারলেই তারা ঝুঁকে পড়েন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে। যাচাই-বাছাই না করেই সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। আবার তা ম্যাচিউরড হলেই বিক্রি করে দেন। এরপর আরেক কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। এখানে সামান্য লাভ হলেই আবারও পোর্টফোলিওতে পরিবর্তন আসে। অন্যদিকে যারা এভাবে লাভ করতে পারেন না, তারাও অন্য কোম্পানিতে লাভ করবেন এমন প্রত্যাশা নিয়ে বিনিয়োগ করেন। ফলে লোকসানেই বিক্রি করে দেন আগের কোম্পানির শেয়ার।

এছাড়া অধিকাংশ সিকিউরিটিজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের বদলে ডে-ট্রেডিংয়ে উৎসাহিত করেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এভাবে লেনদেন করলে বিনিয়োগকারীদের চেয়ে লাভবান হন হাউজ মালিকরা। কারণ হাউজ মালিক প্রতিটি লেনদেন থেকে দুটি করে হাওলা চার্জ পান। এতে তাদের ব্যবসা ভালো হয়।

অন্যদিকে, পুঁজিবাজার মূলত মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করলেওসাম্প্রতিক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করছেন। এতে বাজারে কাক্সিক্ষত পরিবেশ দীর্ঘস্থায়িত্ব পাচ্ছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বাভাকি মার্কেটে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক। বিশে^র উন্নত পুঁজিবাজারগুলোর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে, এ দেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই ডে-ট্রেডার। শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও এখন ডে ট্রেডিং করছে। কারণ তারা স্বল্প সময়ে সামান্য লাভে শেয়ার ছেড়ে দিতে পারছেন। এতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ থাকায় লাভের পরিমাণটাও বেশি হচ্ছে। যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা বড় মূলধনী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোকসান সত্বেও এক শেয়ার ছেড়ে অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করেন।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন ডে-ট্রেডারের ভূমিকা পালন করছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শেয়ার মার্কেটে দুইটি রিস্ক থাকে। একটি হচ্ছে আইটেম স্পেসিফিক রিস্ক অন্যটি হচ্ছে মার্কেট রিস্ক। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হয়তো ঝুঁকি এড়াতেই এটি করছেন। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতন থাকতে হবে। এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও সংযত হতে হবে। তা না হয় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর জন্য এটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ প্রসঙ্গে কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, একটি কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল অবস্থা অর্থাৎ পিই রেশিও, ইপিএস, উৎপাদন, লভ্যাংশ প্রদানে সুনাম, পরিশোধিত মূলধন তুলনামূলক বেশি দেখে বিনিয়োগ করেও মাসের পর মাস কোনো উন্নতি হয়নি। বরং সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে যেসব শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেগুলো থেকে লোকসান দিতে হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর দাম সামান্য বাড়লেও তা স্থায়ী হয় নাই। তারা আরো বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সকলের পরামর্শে মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করলেও বর্তমান বাজারের তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্ব্যহীনতার সুযোগে কতিপয় কারসাজি চক্র দুর্বল ভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে। আর এই কারণে মৌলভিত্তির শেয়ারধারীরা লোকসানের মুখে পড়ছে। ফলে মৌলভিত্তি নামক কোম্পানির শেয়ারের প্রতি আস্থা তারা ধরে রাখতে পারছে না। তারা অভিযোগ করে বলেন, বাজারে কোনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীর কারণে ফান্ডামেন্টাল কোম্পানির শেয়ার গতিশীল হয়ে উঠতে পারছে না। কারণ যখনই এসব কোম্পানির শেয়ার দাম একটু বাড়তে শুরু করে তখনই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দুই এক টাকা মুনাফার দেখা পেলেই শেয়ার বিক্রি করে চাপ সৃষ্টি করে। এতে করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিপাকে পড়েছেন।

বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে ক্ষতি হলেও একদিন তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কারণ মৌলভিত্তির কোম্পানি বছর শেষে ভালো মুনাফা দিতে পারে। এছাড়া এ ধরনের কোম্পানি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অপরদিকে দুর্বলভিত্তির শেয়ার থেকে দ্রুত মুনাফা হলেও দ্রুতই তা হারিয়ে যায়। ফলে বছর শেষে দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি ভালো পরিমাণে লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে না। কাজেই যেকোন পরিস্থিতিতে মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করাকে উত্তম বলে তারা মনে করছেন। তারা আরো বলেন, পুঁজিবাজারের বৃহৎ স্বার্থে ও গতিশীলতা রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আচরণের পরিবর্তন জরুরি। মৌলভিত্তির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা না গেলে মৌলভিত্তিহীন কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর আরো বাড়বে। ফলে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠতে পারে। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকেও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহ্বান জানান তারা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোই বাজারের ভিত মজবুত রাখতে পারে। কিন্তু মৌলভিত্তিহীন কোম্পানির শেয়ার দার যদি অতিরিক্ত বাড়ে তবে বাজার বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। পাশাপাশি সরকারের দেয়া বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সেদিকে নজর দেয়া উচিত।