IDRA20120824174124বিশেষ প্রতিবেদক : আইন যে সবার জন্য সমান নয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও এ সুবিধা নিয়ে কোটি টাকা উপার্জন করলেও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআর) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করারও প্রয়োজন মনে করেননি কমিশন।

ইনসাইডার ট্রেডিং ও সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসা করলেও স্বপদে বহাল আছেন তিনি। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) এ অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বিএসইসি’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সাইফুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টিতে বিজ্ঞ আদালতের কোনো কার্যক্রম চলমান থাকলে বিএসইসি’র কোনো ভূমিকা থাকবে না। বিজ্ঞ আদালতের কোনো নির্দেশনা থাকলে সেটি যথাযথভাবে পরিপালন করা হবে’। এ ধরনের অনিয়মে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বা তাঁকে নিয়োগদানকারী অর্থ মন্ত্রনালয়ও নিরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে।

এর আগে গত ২০১৬ সালের জুনে জনস্বার্থে আদালতে সাংবাদিক এএইচএম আনোয়ারুল করিম বাদি হয়ে একটি রিট দায়ের করেন। মামলার শুনানির পর আদালত এই আদেশ দেন। শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার নওশাদ জমির ও অ্যাডভোকেট রিয়াজুল ইসলাম। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ শেয়ার ব্যবসা করায় তার বিরুদ্ধে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রুল জারি করে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (সুবিধাভোগী) বিধিমালা ১৯৯৫ এর ২(ঙ) এর (অ) অনুযায়ী শেফাক আহমেদ একজন সুবিধাভোগী। তিনি বিমা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর চেয়ারম্যান।

জানা যায়, আইন লংঘন করে ১৫টি বীমা কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদ। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ভাই, বোন ও মায়ের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে তিনি এ ব্যবসা করছেন। বীমা কোম্পানির আগাম তথ্য জেনে মাত্র ৫ কোটি ১৬ লাখ ৮ হাজার শেয়ার কিনে কয়েক মাসেই বোনাস পেয়েছেন আরও ১ লাখ ৮১ হাজার শেয়ার। মতিঝিলের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এমিনেন্ট সিকিউরিটিজে (শেয়ার লেনদেনের প্রতিষ্ঠান) শেয়ার লেনদেন করেন শেফাক আহমেদ। শেয়ার লেনদেন সম্পর্কিত তার বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর ১২০১৭১০০০০০৭৬৩১৪। এ অ্যাকাউন্ট খোলার সময় তার ঠিকানা দেয়া হয় অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর বি-৪, হাউস নম্বর ২০ এবং রোড নং ৬৬, গুলশান ঢাকা। কিন্তু এ ঠিকানায় কাওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ অ্যাকাউন্টে তিনি ১৫টি বীমা কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি সন্ধানী ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং নর্দান জেনারেল ইন্স্যুরেন্স। সূত্র বলছে, উপহার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে এসব কোম্পানির প্লেসমেন্টের বিপুল পরিমাণ শেয়ার নিয়েছেন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান। শেফাক আহমেদের এ শেয়ার ব্যবসার মধ্যে সবচেয়ে অপরাধ হল ইনসাইড ট্রেডিং। যারা কোম্পানির ভেতরের তথ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং সব তথ্য জেনে নিজেরা শেয়ার ব্যবসা করে লাভবান হন। এক্ষেত্রে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদও নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা বীমা কোম্পানির ভেতরের তথ্য আগাম জেনে শেয়ার কিনে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেন। ২০১২ সালে একসঙ্গে ৭ বছরের বকেয়া বোনাস ঘোষণা করে এ বীমা কোম্পানি। ২ হাজার ১০০ শতাংশ বোনাসের এ তথ্য আগেই জানতেন তিনি। ফলে ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকায় ৮ হাজার ৬০০ শেয়ার কিনে কয়েক মাসেই পেয়েছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ১২৫টি শেয়ার। এমনকি নিজে ব্যবসা করার পাশাপাশি ভাই শওকত আহমেদের ১২০১৭১০০০৭৮১৫১৮৭ বিও অ্যাকাউন্টে ২ কোটি টাকায় ৩ হাজার ৫০টি শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বোনাস পান ৬৪ হাজার ৫০টি শেয়ার। আরেক ভাই সাদেক আহমেদের ১২০১৭১০০০৭৮১৫১৭৯ বিও অ্যাকাউন্টে ২ কোটি টাকায় ৩ হাজার ৫০টি শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বোনাস পান ৬৪ হাজার ৫০টি শেয়ার। বোন নাজমা ইসলামের ১২০১৭১০০০৭৮১৪৯৯৩ অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ২ লাখ টাকায় ১ হাজার ৭২৫ শেয়ার কিনে বোনাস মেলে ৩৬ হাজার। আর মা সাইয়্যেদা এফ আহমেদের ১২০১৭১০০০১৬০৫৬৯৪০ অ্যাকাউন্টে ৪৮ লাখ টাকায় ৮০০ শেয়ারের বিপরীতে বোনাস পান ১৬ হাজার ৮০০টি। এসব লেনদেনই অ্যামিনেন্ট সিকিউরিটিজের মাধ্যমে করেছেন।

আইডিআরের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন শেফাক আহমেদ। কিন্তু নিয়োগের আগে এ তথ্য সরকারের কাছে গোপন করেন তিনি। তার হাতে ওই বীমা কোম্পানির এখনও ৫০ হাজারের বেশি শেয়ার রয়েছে। অন্যদিকে ২০০৬ সালে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) এক সার্কুলারের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের ফটকাবাজির (স্পেকুলেটিভ) ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী শেফাক আহমেদের শেয়ার ব্যবসার উল্লেখিত কর্মকান্ড অবৈধ। এ বিষয়ে আইডিআরএ’র নিয়োগবিধিতে উল্লেখ আছে, কেউ যদি তার পদ-পদবি ব্যবহার করে আর্থিক সুবিধা নেন অথবা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তবে তিনি পদে থাকার যোগ্যতা হারাবেন। এছাড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ‘ঙ এবং আ’ ধারায় এ ধরনের লেনদেনের ব্যাপারে শাস্তির কথা বলা আছে।