financial-statements20161028121620এইচ কে জনি : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর অনেক সময় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির আগে ও পরে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে দুই রকম চিত্র ফুটে ওঠে। তালিকাভুক্তির আগে যে কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণে মুনাফা করেছিল, সেই কোম্পানিটিই তালিকাভুক্তির পর ধারাবাহিক লোকসান করে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে আসে। শুধু ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোম্পানির প্রকৃত চিত্র গোপন করে তালিকাভুক্তির কারণেই এমনটি ঘটছে। আর এজন্য কোম্পানির তালিকাভুক্তির সহায়ক ইস্যু ম্যানেজারের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন বিনিয়োগকারীসহ বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, অন্য যে কোনো উৎসের তুলনায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কোম্পানির জন্য বেশ সুবিধাজনক। আর তাই তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনের আগেই দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে অনেক কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর দুর্নীতির অন্যতম সহায়ক ইস্যু ম্যানেজার। ইস্যু ম্যানেজার ও মার্চেন্ট ব্যাংক কোম্পানির দুর্নীতির কথা জেনেও তালিকাভুক্ত হতে সহায়তা করছে।

জানা গেছে, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স প্রদান করার মাধ্যমে বিএসইসি নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষমতা দিয়েছে। মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বাজারকে সমৃদ্ধ করবে এমন কথা বলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিএসইসিকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে। আর মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া তথ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্বাস করছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে প্রতিষ্ঠানটিকে পুঁজিবাজার হতে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোম্পানি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক তথ্য তুলে ধরতে চায় না। আর ইস্যু ম্যানেজারও প্রতিষ্ঠানটিকে সে আর্থিক পরিস্থিতি গোপন করতে সহায়তা করে। আর এই সুযোগে আর্থিক ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের কোম্পানি বাজারে ঢুকে পড়ছে। প্রাথমিকভাবে কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও), শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), রিজার্ভ ইত্যাদি দেখে বিনিয়োগকারীরা ভালো সম্ভাবনা খুঁজে পান। কিন্তু প্রকৃত তথ্য থাকে অন্যরকম। ফলে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে যা হওয়ার কথা তাইই হচ্ছে। পরবর্তী অর্থবছরেই পূর্ববর্তী বছরের আর্থিক তথ্যের সঙ্গে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। কখনো কখনো কোম্পানির খারাপ আর্থিক চিত্র দেখে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নেন। ফলে ক্রমাগতভাবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর পড়তে থাকে। ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী বছরগুলোতে আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির দুর্বলতা ফুটে ওঠার কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে ‘জেড’ অথবা ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে স্থানান্তর করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের ভুল তথ্য কিংবা অনিয়মের জন্য শুধু কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো প্রাথমিক রেগুলেটরের দায়িত্ব পালন করলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার জন্য কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ কিংবা জবাবদিহিতার আওতায় আনছে না বিএসইসি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত সময়ে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিরই তালিকাভুক্তির আগের অবস্থার সঙ্গে পরের অবস্থার কোনো মিল নেই। ব্যবসায়ের পরিধি বাড়ানোর জন্য আইপিও’র মাধ্যমে মূলধন বাড়ালেও এসব কোম্পানির মুনাফা বাড়েনি। এর মধ্যে ইউনাইটেড এয়ার, জিপিএইচ ইস্পাত, জিবিবি পাওয়ার, সায়হাম কটন, আমরা টেকনোলজি, বিকন ফার্মা, ইউনিক হোটেল, ফারইস্ট ফাইন্যান্সসহ তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিরই মুনাফা আগের তুলনায় কমেছে। এছাড়া পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ফ্যামিলি ট্যাক্সের মতো কোম্পানি তালিকাভুক্তির পরই ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে আসার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

বাজার-বিশেষজ্ঞরা জানান, অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) প্রসপেক্টাসে অসম্পূর্ণ আর্থিক তথ্য দেখিয়ে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিচ্ছে। এতে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার অনেক অসাধু মার্চেন্ট ব্যাংক এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করছে- যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তারা আরো বলেন, কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ইস্যু ম্যানেজারকে বিভিন্ন শর্ত দেয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির আর্থিক বিবরণী কোম্পানির চাহিদা মাফিক তৈরি করে থাকে। কখনো বা কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্য গোপন করে। ফলে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন দেখে বাস্তব অবস্থা বোঝার উপায় থাকে না। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে যখন ইস্যু ম্যানেজারের মাধ্যমে কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জানায় বা নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম দাবি করে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবেদন দেখে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকৃত অবস্থা বুঝা সম্ভব হয় না। তারা আরো জানান, ডিসক্লোজারভিত্তিক আইপিও অনুমোদন ও গতানুগতিকভাবে সেই কোম্পানিগুলোকে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করায় ক্রমেই ঝুঁকি বাড়ছে। নতুন কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারী ও প্লেসমেন্টহোল্ডাররা লাভবান হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা কিন্তু ক্রমেই ভারী হচ্ছে। কারণ, লেনদেন শুরুর প্রথম দিকে কোম্পানির শেয়ার দরের উল্লম্ফন থাকলেও ক্রমেই তা নিম্নমুখী হয়। তারা জানান, তালিকাভুক্তির আগে স্টক ডিভিডেন্ড ও তালিকাভুক্তির পর নামমাত্র ডিভিডেন্ড ও অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানির সার্বিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।

এ দায় বিএসইসিকেই নিতে হবে জানিয়ে বিনিয়োগকারীরা বলেন, কোনো কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়ার আগে কোম্পানিটির সার্বিক তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব বিএসইসির, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নয়। অবশ্য বর্তমান সময়ে কোনো কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের বিপক্ষে বিনিয়োগকারী কিংবা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তথ্যচিত্র তুলে ধরলেও নীতি-নির্ধারণী মহলের টনক নড়ে না। সবসময়ই তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত নই’ কিংবা ‘আমরা বিষয়টি নজরে এনেছি’ কিংবা ‘কোন অনিয়মের প্রমাণ পেলে অবশ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’ ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে একজন বিনিয়োগকারী কিংবা একজন সংবাদ প্রতিনিধি যদি কোম্পানির অসঙ্গতি ধরতে পারে তবে নীতি নির্ধারণী মহল কেন পারছে না? এক্ষেত্রে আইপিও অনুমোদনে বিএসইসি’র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

এদিকে, আইনি দুর্বলতার কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এড়াতেই দেশের শীর্ষ মুনাফাভোগী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসছে না। বিএসইসিকে তালিকাভুক্তির বিষয়ে যে কোনো কোম্পানির ওপর শর্তারোপ করার ক্ষমতা দেয়া থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক এই প্রতিষ্ঠানটি। আর এ সুযোগে জবাবদিহিতা এড়াতে দেশের শীর্ষ ব্যবসা সফল ও মুনাফাভোগী কোম্পানিগুলোর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে বরাবরই অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা না থাকায় বিভিন্ন গ্রুপের একই মালিকানাধীন বা পারিবারিক কোম্পানিগুলো দেশের ব্যবসা জগতে শীর্ষস্থানে থাকলেও বরাবরই পুঁজিবাজারে আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। অথচ এসব কোম্পানি নিজেদের স্বাধীন মতো ব্যবসা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। তবে এসব বড় বড় করপোরেট ও কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে একদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে বাজারে ভালো শেয়ারের ঘাটতি পূরণ হবে। আর তাই প্রয়োজনে আরো কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এসব কোম্পানিগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব বাজারে আনতে বিএসইসি’র প্রতি আহ্বান জানান বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী দেশীয় কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা অতিক্রম করলে এক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এসব কোম্পানি সুকৌশলে আইনের বিভিন্ন ফাঁক-ফোকরের মাধ্যমে তালিকাভুক্তি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির জন্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশের ৩ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে হয়। কোনো কোম্পানি নির্ধারিত এ সময়ে মধ্যে তালিকাভুক্ত হতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে ৬ মাস সময় বাড়াতে পারে। তবে তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এসব বীমা কোম্পানিকে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা হারে জরিমানা দিতে হচ্ছে। তবে অন্য কোম্পানির জন্য এ ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-এর ইস্যু অব ক্যাপিটালের ২(এ) ধারা অনুযায়ী, দেশি-বিদেশি যে কোনো কোম্পানির মূলধনের ওপর বিএসইসি’র কর্তৃত্ব রয়েছে। যে কোনো কোম্পানির ওপর শর্ত, চুক্তি, মেমোরেন্ডাম দেয়ার ক্ষমতা বিএসইসিকে দেয়া হয়েছে। অথচ বিএসইসি এ কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দীন আলী আহমেদ জানান, আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াও পুঁজিবাজারের অস্বচ্ছতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করায় অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে না। তবে পুঁজিবাজারকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করা গেলে অবশ্যই ভালো কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হবে। তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে জবাবদিহিতা অনেক বেড়ে যায়। কেননা তিন মাস পর পর অডিট করে অ্যাকাউন্টস নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দাখিল করতে হয়। ভালো ডিভিডেন্ড না দিতে পারলে শেয়ারহোল্ডারদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে জবাবদিহিতার বিষয়টি যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। মূলত এসব কারণে অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হয় না। সবার অধিকার আছে যে, সে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করবে। কিন্তু তালিকাভুক্ত না হলে তা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির বিকাশের জন্য ক্ষতির কারণ। আর জনসাধারণকেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।