dividend-Warrantএইচ কে জনি : বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্যই মুনাফা। যেখানে বিনিয়োগ করলে মুনাফা হবে না, সেখানে কেউই বিনিয়োগ করবে না- এটাই স্বাভাবিক। একটি কোম্পানি যখন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, তখন তার উদ্দেশ্য থাকে যে উত্তোলিত অর্থে ব্যবসায়ের উন্নয়ন করা। আবার একজন বিনিয়োগকারীও বছর শেষে ভালো ডিভিডেন্ডের আশায় ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকে। পৃথিবীর সব দেশের পুঁজিবাজারেই একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো মুনাফার বৃহৎ অংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের প্রদান করে থাকে। আর মুনাফার বাকি অংশ আপদকালীন সময়ের জন্য রিজার্ভ ফান্ডে সংরক্ষন করা হয়। বিশেষ করে মৌলভিত্তি খ্যাত স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো ডিভিডেন্ড প্রদানে তেমন কার্পন্য দেখায় না। এতে কোম্পানির সুনাম অক্ষুন্ন থাকার পাশাপাশি এসব শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশীই থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অধিকাংশ কোম্পানিই শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ছল-ছাতুরির আশ্রয় নেয়। কোন কোন কোম্পানি বছরের পর বছর ক্যাটাগরি রক্ষার জন্য নামমাত্র ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকে। আবার কোন কোন কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুনাফা কম দেখায়। এতে বরাবরই বিনিয়োগের প্রত্যাশিত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর তাই ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের ধসের পর দীর্ঘ ছয় বছরের মন্দার কবলে বিনিয়োগকারীরা যখন নিঃস্ব তখন একটু আশার আলো খুঁজতে থাকেন ডিভিডেন্ড ঘোষণার ওপর। কিন্তু সে আশাও বিফলে যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সমাপ্ত হিসাব বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গড় ডিভিডেন্ড প্রদানের পরিমাণ এর আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এদিকে বিনিয়োগকারীরা বারবার কোম্পানিগুলোর কাছে আবেদন করে আসছে তাদের লোকসানের কথা বিবেচনা করে ডিভিডেন্ডের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কথায় কেউ কর্ণপাত করছে না।

যদিও এ বছর তালিকাভুক্ত সবগুলো কোম্পানির ডিভিডেন্ড ঘোষণা এখনো শেষ হয় নি। তবে ২০১৬ সালেও এর আগের বছরের তুলনায় গড় ডিভিডেন্ডের পরিমাণ অনেকটাই কমেছিল। ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গড় ডিভিডেন্ডের পরিমাণ ছিল ৩৫.৪৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা কমে ২৭.৭৮ শতাংশে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গড় ডিভিডেন্ডের পরিমাণ ৭.৬৯ শতাংশ কমেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত কোম্পানির ডিভিডেন্ড প্রদানের উপর নির্ভর করে শেয়ার ক্রয় করেন। তাই পুঁজিবাজার ভালো হওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড বড় অবদান রাখে। কোম্পানির ডিভিডেন্ড বাড়তে শুরু করলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে।

এদিকে, নীতিমালা না থাকায় কোম্পানির রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা চলছে। এতে করে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি কোম্পানির কি পরিমাণ অর্থ রিজার্ভ থাকবে তার সীমা না থাকায় কোম্পানিগুলো রিজার্ভের পাহাড় গড়ছে। কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফা করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে রিজার্ভের নামে সংরক্ষণ করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, আর পরিচালকরা এক পর্যায়ে সে রিজার্ভের মালিক হচ্ছেন।

সাধারণত, কোনো কোম্পানি যদি পর্যাপ্ত রিজার্ভ না রাখে, তবে বিনিয়োগকারীরা সেসব কোমপানিতে আস্থা রাখতে পারেন না। আবার কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে ডিভিডেন্ড না দিয়ে রিজার্ভ বাড়ালে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন বিনিয়োগকারীরা। তবে অতিরিক্ত রিজার্ভ বিনিয়োগকারীদের জন্য কতটা লাভজনক- এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতভেদ থাকলেও পুঁজিবাজারে চলছে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই বিনিয়োগকারীদের মুনাফা না দিয়ে রিজার্ভের পাহাড় গড়ে তুলছে। তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি কী পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারবে এবং কীভাবে সেই রিজার্ভ ব্যয় করবে এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসাধু প্রতিযোগিতা চলছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির আস্থার হাতিয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফা করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে রিজার্ভের নামে সংরক্ষণ করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, আর পরিচালকরা এক পর্যায়ে সে রিজার্ভের মালিক হচ্ছেন।

এদিকে, ডিভিডেন্ড কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে একাধিক কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, গত বছর কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা করতে না পারলেও এ বছর ভালো করছে। তাই আগামীতে ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। তবে কেউ কেউ বলছেন, কোম্পানিগুলোর মুনাফা আসলে খুব কমেনি। যতটুকু মুনাফা হয়েছে সেখান থেকে রিজার্ভ রাখার ফলে ডিভিডেন্ড কম দেওয়া হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বেশকিছু কোম্পানি ভালো মুনাফা করলেও সঠিকভাবে ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। ডিভিডেন্ড না দিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর ফলে তারা হতাশ হচ্ছেন। তবে রিজার্ভ বাড়ানোর ফলে পরবর্তী বছরে যদি কোম্পানির মুনাফা ও ডিভিডেন্ড বাড়ে তা হলে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হতেন না। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানিই বছরের পর বছর ধরে মুনাফা করে তা থেকে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। রিজার্ভ বাড়িয়েও যেভাবে কোম্পানির গ্রোথ (মুনাফা বাড়া) হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। তাই কোম্পানির ডিভিডেন্ড প্রদান ও রিজার্ভ বিষয়ে নীতিমালা থাকা দরকার। তারা আরও অভিযোগ করেন, অধিকাংশ কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিলেও তা নগদ (ক্যাশ ডিভিডেন্ড) না দিয়ে শেয়ার (বোনাস শেয়ার) আকারে দিচ্ছে। এতে শেয়ার দরে বড় ধরনের ধস নামে। সার্বিক দিক বিবেচনায় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণই বেশি হচ্ছে।

এ সময় তারা ব্যাংক খাতের কোম্পানি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ঘোষিত ডিভিডেন্ড নিয়েও সমালোচনা করেন।
জনতে চাইলে এম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী নুরুল আজম বলেন, কোম্পানির মালিক হচ্ছে শেয়ারহোল্ডাররা। বিশে^র সব দেশেই শেয়ারহোল্ডারদের গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে শেয়ারহোল্ডাদেরকে বঞ্চিত করে রাখে। কোম্পানির মালিকদের কাছে শেয়ারহোল্ডাররা জিম্মি। কোম্পানির এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষ থেকে পরিচালক হতে চাইলে হুমকিও দেয়া হয়ে থাকে।

তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, শেয়ারহোল্ডার আর পরিচালক এক কথা নয়। অথচ পরিচালকদের কারসাজির কারণে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া যে সকল কোম্পানি রিজার্ভ থাকা স্বত্বে ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না তাদের জন্য আইন করা উচিত বলে তিনি মনে করছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বলেন, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বাজারে আসার পরপর ভালো ডিভিডেন্ড দেয়। এরপর ধীরে ধীরে ডিভিডেন্ড কমাতে থাকে। এমনকি কিছু কোম্পানি আর ডিভিডেন্ডই দেয় না। ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের ডিভিডেন্ড কমেনি, বরং বেড়েছে। তাই নতুন কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড কেন কমে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির আস্থার হাতিয়ার। রিজার্ভ ফান্ড কোম্পানিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সহযোগিতা করে। তবে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করে রিজার্ভ বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত নয়। ব্যাংক-বিমার রিজার্ভ ফান্ড বেশি থাকা স্বাভাবিক। তবে অন্যান্য খাতের কোম্পানির অতিরিক্ত রিজার্ভ বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধাজনক নয়। তাই কোম্পানিগুলোর কাছে সত্যি রিজার্ভ রয়েছে, নাকি শুধুই কাগজে-কলমে দেখাচ্ছে, তাও নজরদারির পরামর্শ দেন তিনি।