ঢাকা_স্টক_এক্সচেঞ্জ-এর_লোগো.svgএইচ কে জনি : পুঁজিবাজারের বিভিন্ন নীতি-নির্ধারক ও স্টেক হোল্ডারদের সমন্বয়হীনতার কারণে পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিশেষ করে একই ইস্যুতে নীতি-নির্ধারকদের ভিন্ন মত, আইনের সদ্ব্যবহার না হওয়াসহ নানা ইস্যুতে বাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসছে না। এছাড়া কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আইনী জটিলতা ও নীতি-নির্ধারনী মহলের উদাসীনতায় দুর্বল কোম্পানিকে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়ায় বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট বাড়ছে। এতে বাজারে সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারী সমানতালে অংশগ্রহণ না করায় বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে।

তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৪ এপ্রিল দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৮৪ হাজার ৭৪৯ কোটি ২৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। যা আজ ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৮৪ কোটি ৯২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে মাত্র ২৭ কার্যদিবসের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ৯৬৪ কোটি ৩৬ লাখ ৩ হাজার টাকা।

তাদের মতে, ২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় বাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বারংবার তা পতনের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। মাঝে মধ্যে বাজারে কয়েকবার আশার আলো উকি মারলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগে নি। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান কমার বদলে বাড়ছে। মুলত, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত না হওয়া, শাস্তি প্রদানে ধীরগতি, জরিমানার নামে প্রহসন, কোম্পানিগুলোতে প্রফেশনাল ম্যানেজম্যান্ট ও গুড গভর্ন্যান্স না থাকা, নীতি-নির্ধারণী মহলের সমন্বয়হীনতা, ওটিসি মার্কেটের বেহাল দশা, দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে অনীহা, আইপিও অনুমোদনে অস্বচ্ছতা এবং আর্থিক প্রতিবেদন তৈরীতে অনিয়মের কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাজারে আস্থা রাখতে পারছেন না। এতে বাজার হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক গতি।

অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে ডিমিচ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে পৃথক করা হয়েছে। এতে একশ্রেনীর সুবিধাভুগী গোষ্ঠির স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটে। পরিণতিতে ওইসব ব্যক্তিবর্গের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে নিশ্চুপ থেকে নতুন পরিচালনা পর্ষদকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এছাড়া বাজারের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও কারসাজি চক্রের স্বীয় স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এতে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর তলানীতে গিয়ে ঠেকলেও বাড়ছে স্বল্পমূলধনী কোম্পানির শেয়ার দর। অথচ নীতি নির্ধারনী মহলের পক্ষ থেকে কারসাজি চক্রের অপচেষ্টা বন্ধের চেষ্টা না করে বরং বিনিয়োগকারীদের ঘাড়েই দোষ চাপানোর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, ধস পরবর্তী সময়ে বাজারকে স্থিতিশীল করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। যা পুঁজিবাজারের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সময়োপযোগী না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা তেমন কোন উপকার পায় নি। এর মধ্যে ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে কারসাজির তদন্ত; ২০১১ সালের মে মাসে তৎকালীন এসইসির সংস্কার; কমিশনার আনোয়ারুল কবিরের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ; কারসাজির অভিযোগে ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের; ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর ২ সিসি ক্ষমতাবলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা আরোপ এবং ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিদেশী ব্রোকারেজ ফার্মকে প্রদেয় কমিশন দ্রুত পাওয়ার ব্যবস্থা করা; প্রাইভেট প্লেসমেন্টের নীতিমালা সংস্কার; বুকবিল্ডিং পদ্ধতি সংস্কার; রাইট শেয়ার রুলস সংশোধন; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে করপোরেট গাইডলাইনস প্রণয়ন; ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগ চালু; অত্যাধুনিক সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার সংযোজন; পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন; স্টক এক্সচেঞ্জ বিন্যস্তকরণ; অমনিবাস অ্যাকাউন্ট বিলুপ্তি; মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারদের প্রভিশনিংয়ের সুবিধা প্রদান; মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা সংশোধন; মেম্বার মার্জিন লিমিট নিয়ন্ত্রণ; বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সুবিধা প্রদান; নতুন আইপিও নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি। এছাড়া ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কমিশন। এরমধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কাঠামোর মধ্যে আনা, ডেরিভেটিভ মার্কেট প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র ক্লিয়ারিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা এবং বন্ড মার্কেটের প্রসারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিএসইসি ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কতিপয় সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে বীমা তহবিলের (লাইফ ও ননলাইফ) বিনিয়োগযোগ্য অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্যোগ, গুজব নির্ভর ও নিউজ সেনসেটিভ পুঁজিবাজারের পরিবর্তে একটি পূর্ণ সচেতন মূলধন বাজার তৈরির লক্ষ্যে ইনভেস্টমেন্ট এডভাইজরি সার্ভিস উন্মুক্ত করলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মার্চেন্ট ব্যাংক ও সাবসিডিয়ারিসমূহের নিজস্ব মূলধন বাড়ানোর জন্য বিএসইসি দ্রুত উপায় উদ্ভাবনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলো আইপিওতে আসার অনুমোদন দেয়নি। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও বিএসইসি তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, জিডিপির হার অনুসারে পুঁজিবাজারের মার্কেট ক্যাপিটাল হচ্ছে সর্বনিম্ন। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ যাচ্ছে, তার তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে যে অর্থ যাচ্ছে তা একেবারেই নগণ্য। তারা বলেন, যদি কোনো কোম্পানি সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করে আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা দেখায় তাহলে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করে ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা হতে দেখা যায় না। আইনের ব্যত্যয় ঘটলে বিএসইসিকে তা চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এ দেশে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা ধীর গতিতে চলে। তারা জানান, পুঁজিবাজারে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভূক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবদের যৌথ বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে তালিকাভূক্ত হবে। এতে বাজারে ভালো শেয়ারের যোগান বাড়বে।

ওটিসি মার্কেট সম্পর্কে তারা বলেন, এ মার্কেটে যেসব কোম্পানি আছে তা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল মার্কেট থেকে তালিকাচ্যুত হয়েছে। তবে ওটিসি মার্কেটের মূল কনসেপ্ট এটা নয়। এ মার্কেটে ক্ষুদ্র পুঁজির কোম্পানির সুযোগ থাকবে যারা ধীরে ধীরে পুঁজি বাড়িয়ে ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করে মূল মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু এখানে তা হয় না। তারা আরো বলেন, যেকোনো কোম্পানির অবস্থা জেনে বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। টাকা আপনার তাই লোকসান হলে আপনাকেই বহন করতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারী অবশ্যই মুনাফা করবেন। কারণ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ বাজারে যত বিপর্যয় হোক না কেন সম্ভাবনার সুযোগ রয়েছে। এ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারসহ সকল রেগুলেটরদের দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এগুলো বাস্তবরূপ দিতে পেশাদার ব্যবস্থাপনা, গুড গভর্নেন্স, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভাল কোম্পানি তালিকাভূক্ত করাতে হবে। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় হলে পুঁজিবাজারে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে বলেও তারা মনে করেন।