bsaec (1)এ কে এম তারেকুজ্জামান : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির লাভ-ক্ষতি, বার্ষিক লভ্যাংশ ঘোষণা বা ভবিষ্যৎ ব্যবসা পরিকল্পনা সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কারসাজির চলছে। তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে যোগসাজশে কারসাজি করে তাদের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য ভুল দিয়ে থাকে। মূলত সরকারকে ট্যাক্স ও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার ভয়েই কোম্পানিগুলো এই কারসাজির আশ্রয় নেয় বলে অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিনিয়োগকারীর।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কারসাজির মাধ্যমে নিট মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস বাড়িয়ে চড়া দামে বোনাস শেয়ার বিক্রি করছে কোম্পানির মালিকরা। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগাম জেনে যাচ্ছেন পুঁজিবাজারের এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা। এসব আগাম তথ্যের ভিত্তিতে তারা আগেই শেয়ার কিনে পরে তথ্যটি বাজারে ছড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

পুঁজিবাজারের অসংখ্য কোম্পানি রয়েছে যারা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং-এ (আইপিও) আসার আগে তাদের ইপিএস অনেক বেশি দেখায়। এরপর আইপিওতে এসে প্রিমিয়াম ও ফেসভেল্যু পাওয়ার পর ইপিএস বেশি হলেও কম দেখিয়ে থাকে। কোম্পানি ও ব্যাংকগুলোকে যথাক্রমে ইপিএস এর শতকরা সাড়ে ৩৭ ও ৪২ ভাগ ট্যাক্স সরকারকে দিতে হয়। এই ট্যাক্স দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অধিকাংশ কোম্পানি ইপিএস কম দেখিয়ে থাকে। শুধু ট্যাক্স ফাঁকিই নয়, ইপিএস বেশি দেখানো হলে শেয়ারহোল্ডারদেরকে বেশি পরিমাণে লভ্যাংশ দিতে হয়। এই ভয়েও অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের ইপিএস বেশি হলেও কম দেখিয়ে থাকে বলে অভিযোগ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

তারা আরও জানান, সম্প্রতি ডিএসই যে আর্থিক প্রতিবেদনে ভুল তথ্য পেয়েছে তা একধরনের আইওয়াশ। এর বাইরেও অসংখ্য কোম্পানি রয়েছে যারা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির সঙ্গে কারসাজি করে সঠিক তথ্য দেয় না। ভুল তথ্যকেই সঠিক তথ্য বলে চালিয়ে দেয় হয়। ফলে ব্যবসায়ের সঠিক তথ্য থেকে প্রতারিত হয় বিনিয়োগকারীরা।

তাদের মতে, কিছু কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কারসাজি করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে ইপিএস বেশি দেখায়। আর বেশি লাভের আশায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তখন কারসাজি চক্র তাদের হাতে থাকা শেয়ার দ্রুত সেল করার জন্য সক্রিয় হয়। এরপর বার্ষিক রিপোর্টে তারা ইপিএসের পরিমাণ কম দেখিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ঢেলে দেয়। এভাবেই চলছে দেশের ক্যাপিটাল মার্কেট। এই মার্কেটের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। এই দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

একইভাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে পুঁজিবাজারে চলছে কারসাজি। তেমনি ইপিএসে বড় ধরণের গরমিল দেখায় গ্রীণডেল্টা ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির প্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের আয়সহ শেয়ারপ্রতি সমন্বিত লোকসান দেখায় ০.৮৪ টাকা এবং এককভাবে শেয়ারপ্রতি লোকসান দেখায় ১.৯৫ টাকা। কিন্তু ডিএসই’র ওয়েবসাইটে কোম্পানিটির প্রোফাইলে প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখায় ০.৮৮ টাকা। এ বিষয়ে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ হলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রথম প্রান্তিকের ইপিএস-এ ভুল তথ্য ছাপা হয়েছে। এটা আসলে অনিচ্ছাকৃত ভুল। আসল সমন্বিত ইপিএস হচ্ছে ০.৮৮ টাকা।

এদিকে প্রকৌশলী খাতের কোম্পানি দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি নিজেদের মতো করে ইপিএস ‘বানাতে’ গিয়ে ধরা খেয়েছে। ইপিএসে বড় গড়মিল প্রকাশ পেয়েছে। জানা গেছে, কোম্পানিটি আলাদাভাবে তিন প্রান্তিকের (জুলাই’ ১৬-সেপ্টেম্বর’ ১৭), (অক্টোবর’ ১৬-ডিসেম্বর’ ১৭) এবং (জানুয়ারি’ ১৬-মার্চ’ ১৭) যে ইপিএস দেখিয়েছে, তিন প্রান্তিকের মোট ইপিএস দেখিয়েছে তার চেয়ে কম।

সম্প্রতি কোম্পানিটি তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আইন অনুযায়ী, কোম্পানিটি দেশের বহুল প্রচলিত একটি বাংলা, একটি ইংরেজি দৈনিক ও একটি অনলাইনে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য হিসাবে তা প্রকাশ করে। কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, (জানুয়ারি-মার্চ’ ১৭) কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ১৯ পয়সা।

ডিএসইস সূত্র মতে, এর আগে কোম্পানিটি প্রথম প্রান্তিকে ১৬ পয়সা ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২২ পয়সা আয় করেছে। সব মিলিয়ে ৯ মাসে কোম্পানিটির ইপিএস হওয়ার কথা ৫৭ পয়সা। কিন্তু কোম্পানি ইপিএস দেখিয়েছে ৪০ পয়সা।

এ বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, ভুলবশত কাজটি হয়ে গেছে। আমরা এটি সংশোধন করবো। এরই অংশ হিসাবে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের প্রয়োজন মাফিক ইপিএস বাড়ানো কমানো গর্হিত অপরাধ। কিন্তু গ্রীণডেল্টা ইন্স্যুরেন্স তাই করেছে। বাড়তি দামে শেয়ার বিক্রি করতে তারা আগে আয়করের জন্য সঞ্চিতি না রেখে মুনাফা ও ইপিএস বাড়িয়ে দেখিয়েছে। তাদের শেয়ার বিক্রি শেষ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী প্রান্তিকে তারা বকেয়াসহ সব কর একসঙ্গে পরিশোধ করেছে। এতে শেয়ারের দাম কমে গেছে। তাতে অসংখ্য বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের কারসাজির প্রমাণ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে বিএসইসি।

পুঁজিবাজারের এই অপতৎপরতা বছরের পর বছর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নাকের ডগায় ঘটছে। তারপরও সংস্থাটি একেবারেই নির্বিকার। এমনকি কমিশনের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিশ্বাস করেন, কারসাজিমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক, শীর্ষ কর্মকর্তা, তাদের নিকটাত্মীয় এবং অডিটর জড়িত থাকে। তারপরও তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কারসাজিমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে অনেক দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে থাকে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী কারসাজিমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হলেই ওই সংস্থা কমিশনের নজরে আনে। আমাদের দেশেও এ প্রথা চালু করা উচিৎ।