573c5566ed85b_image

বিশেষ প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে অন্য যেকোন খাতের তুলনায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলভিত্তির ব্যাংকিং খাতকেই নিরাপদ বলে মনে করতেন বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এ খাত তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল। মুলত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরশীলতা, পুঁজিবাজারে মুনাফা কমে যাওয়া, উচ্চ সুদে অর্থ সংগ্রহ, খেলাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মূলধন ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে নতুন উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে অনাগ্রহ, বিভিন্ন শিল্পে মন্দাবস্থা এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে লোকসানের কারণে এ খাতের ওপরে আর আস্থা রাখতে পারছিলেন না বিনিয়োগকারীরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের কঠোর মনোভাব এবং ব্যাংকারদের আন্তরিক প্রচেষ্টার বলেই আবারও আগের রুপে ফিরে এসেছে এ খাতের কোম্পানিগুলো। অর্থ্যাৎ ২০১৭ সালের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) এ খাতের অধিকাংশ কোম্পানির পরিচালন মুনাফা এর আগের বছরের তুলনায় প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। শুধু তাই নয়, গত বছরেও (২০১৬ সমাপ্ত বছরে) এ খাতের কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা করেছিল।

জানা গেছে, এবার ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় অংশই এসেছে ঋণের সুদ, কমিশন, সার্ভিস চার্জ, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার আয় থেকে। এছাড়া সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সময়ে দেয়া ঋণ থেকেও বড় ধরনের আয় আসায় সামগ্রিকভাবে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এছাড়া বিদায়ী বছরে ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে খেলাপি না করার কারণেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

তবে পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফনের এ হিসাব প্রাথমিক। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। অর্থাৎ চূড়ান্ত হিসাব শেষে পরিচালন মুনাফা থেকে সঞ্চিতি ও কর কেটে রেখে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা পাওয়া যাবে। পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে হবে। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ১ থেকে ২ শতাংশ, খেলাপির মধ্যে নিম্নমান ঋণে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এরপরে মূলধন বাড়াতে তহবিলের একটি অংশ নিতে হবে রিজার্ভ তহবিলে। পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ৪১ শতাংশ হারে আয়কর। এরপরে যা থাকবে তা ব্যাংকের নীট মুনাফা হিসেবে গণ্য হবে। এই নীট মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া যাবে।

তবে বিদায়ী বছরের পাশাপাশি চলতি বছরের প্রথমার্ধে এ খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়ায় পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। কারণ মুনাফা বাড়ায় এ কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ডের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়বে। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগকারীরাও ভালো মুনাফার আসায় ব্যাংকগুলোকেই বিনিয়োগের জন্য বেছে নেবেন। যার প্রভাব পড়বে সূচকে। সবমিলিয়ে দেশের পুঁজিবাজার নতুন মেরুকরণের পথেই হাটছে বলে মনে করছেন তারা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চলতি ২০১৭ বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। তবে আলোচ্য সময়ে মুনাফার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর গত বছরের তুলনায় এ বছরে মুনাফায় সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফন ঘটেছে রূপালী ব্যাংকের। আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ৬৪৩ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৮৬৬ কোটি টাকা। আর মুনাফায় প্রবৃদ্ধিতে সেরা হয়েছে রূপালী ব্যাংক। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৩৫ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৪৩ শতাংশ।

একই সময়ে পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। যা ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে ছিল ২৯৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে ব্যাংক এশিয়ার পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ২৭৯ কোটি টাকা।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৩২৫ কোটি টাকা, আগে ছিল ২৭৮ কোটি টাকা। ডাচবাংলা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৩৫০ কোটি টাকা, আগে ছিল ৩২৪ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৩৬০ কোটি টাকা, আগে ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ৩২০ কোটি টাকা, আগে ছিল ২৫৫ কোটি টাকা। এনসিসি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৩৭ কোটি টাকা, আগে ছিল ২০১ কোটি টাকা। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১৭৩ কোটি টাকা, আগে ছিল ১৫৯ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৫০ কোটি টাকা, আগে ছিল ২০০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২২২ কোটি টাকা, আগে ছিল ১৬৭ কোটি টাকা। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২০৯ কোটি টাকা, আগে ছিল ২০০ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৬৭ কোটি টাকা, আগে ছিল ২২৫ কোটি টাকা। ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ২৯৩ কোটি টাকা, আগে ছিল ২৫১ কোটি টাকা।

তবে পরিচালন মুনাফা কমেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৫৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মুনাফা কমেছে ৪৯ শতাংশ কমেছে। এছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা সামান্য কমেছে। ২০১৭ সালের প্রথম ভাগে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৪১১ কোটি টাকা, যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ৪২০ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা, যা এর আগের বছর ছিল ২০৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের পরিচালন আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে পরিচালন মুনাফা বের করা হয়। এটি ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য প্রভিশন ও ট্যাক্স পরিশোধ করে তবেই একটি ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়।

তারা আরও জানান, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (অর্ধবার্ষিকে) দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সে হিসাবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক ব্যাংকেরই নিট মুনাফা কমে যাবে।