ইতিহাসের পুঁজিবাজার : কাঠের টুকরো থেকে দেশ শাসন
আসিফুজ্জামান পৃথিল : আধুনিক বিশ্ব বাণিজ্যে বাজার ব্যবস্থা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এবং বাজার ব্যবস্থার প্রধানতম স্তম্ভ পুঁজিবাজার। আজকের পুঁজিব্যবস্থা এবং আধুনিক পুঁজিবাজার একদিনে গড়ে উঠেনি। হাজারো বছরের পুরাতন ইতিহাস আছে পুঁজিব্যবস্থার। পুঁজিবাজার গড়ে উঠার পেছনের গল্পটা অনেক বেশী রোমাঞ্চকর। এর পরতে পরতে ইতিহাসের নানান যুগসন্ধিক্ষণের গল্প লুকিয়ে আছে। এর মধ্যে যেমন পাওয়া যায় পৃথিবীর প্রথম প্রজাতন্ত্রের গল্প, তেমনি পাওয়া যায় প্লেগের প্রভাবে খালি হয়ে যাওয়া ইউরোপের রেনেসাঁয় ঘুরে দাঁড়াবার গল্পটাও। মেরিটাইম বাণিজ্যের সোনালী ইতিহাসের শুরু এবং উপনেবেশিকতাবাদের কালো অধ্যায়ও জড়িত পুঁজিবাজারের ইতিহাসের সঙ্গে।
আজকের আদলে শেয়ারের লেনদেন প্রথম শুরু হয় রোমান প্রজাতন্ত্রে। রোমান অভিজাত সিনেটররা নিজেদের মধ্যে পরিচিত ছিলেন পাবলিকানি নামে। পাবলিকানিরা প্রথম পাবলিকানিরাম নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন, যার সঙ্গে আজকের দিনের জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মিল পাওয়া যায়। এই পাবলিকানিরাম এর স্টেক হোল্ডাররা নিজেদের ক্ষমতার মাপকাঠি অনুযায়ী কিছু কাঠের টুকরা বা স্টেক পেতেন। সেই কাঠের টুকরাগুলিই তাঁদের ক্ষমতার নির্দেশক ছিলো।
১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের তুলুজ শহরে বাজাকেল মিলিং কোম্পানির ৯৬টি শেয়ার বিক্রয় হয়। এই শেয়ারগুলোর দর তুলুজের সামাজিক একটি কোম্পানির মুনাফার উপর নির্ধারিত হয়। ১২৮৮ সালে খনিজ এবং বনজ দ্রব্য উৎপাদনকারী সুইডিশ কোম্পানি স্টোরার একটি স্টক ডকুমেন্ট ট্রান্সফার করে। যেটিতে বিশপ অফ ভাস্তেশরাসের ১২.৫ শতাংশ শেয়ার দেখানো হয় স্টোরার খনি ব্যবসায়। যেখানে তিনি গ্রেট কপার মাউন্টেন বা ফালুন মাইনের বদলে নিজের একটি “এস্টেট” প্রদান করেছিলেন।
এই লেনদেনগুলোকেই বলা যায় শেয়ার ব্যবসার সূচনা। তবে এগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে হয়েছিল, কোন প্রথাগত বাজার ব্যবস্থা তখনও গড়ে ওঠেনি।
পৃথিবীর প্রথম পুঁজিবাজার : বলা হয়ে থাকে বেলজিয়ামের অ্যাণ্টওয়ার্পে পৃথিবীর প্রথম পুঁজিবাজার গড়ে ওঠে। বেলজিয়ামের ৪টি রাজ্য বারগেস, ফ্ল্যান্ডার্স, ঘ্যান্ট এবং রটরডাম ১৪০০-১৫০০ সালের মধ্যে নিজেদের পুঁজিবাজার গড়ে তোলে ফ্ল্যান্ডার্স এর অ্যান্টওয়ার্প শহরে। সে সময় অ্যান্টওয়ার্প ছিলো বেলজিয়ামের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বেলজিয়ামের প্রভাবশালী ভ্যান ডার ব্রুজ পরিবারের আবাসস্থল। তাই সাধারণভাবে এই বাজারকে বলা হতো, ‘ব্রুজেন’।
তবে শুরুর এই বাজারে আজকের মতো “স্টক” ছিলো না। ছিলো না বাজার থেকে পুঁজি তুলে মূলধন বাড়াবার কোনো পদ্ধতি। সেখানে সরাসরি সম্পদের হাতবদল হতো।
পৃথিবীর প্রথম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি : পৃথিবীর প্রথম জয়েন্ট স্টক কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপনিবেশিকতার নগ্ন ইতিহাস। সেই সঙ্গে গুমরে মরে একটি বিশাল দেশকে কুক্ষিগত করে এক শতাব্দিব্যাপী সেই দেশের মালিক বনে যাবার কদর্য গল্পটাও।
১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাবলিক ফান্ড উত্তোলনের মাধ্যমে গঠন হয় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেদিনই ব্রিটেনের রাণী ”এলিজাবেথ ১” একটি “রয়েল চার্টার” বা রাজকীয় ফরমান ইস্যু করার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম কর্পোরেট কোম্পানি হিসেবে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্বীকৃতি দেন। শুরুতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল ব্যবসা ছিলো কার্পাস তুলা, রেশম, নীল, সালফার, লবন, চা এবং আফিম আমদানী করা। মেরিটাইম ট্রেড এবং বাট্টা কাটার মাধ্যমে তাঁরা পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ চীনে ব্যবসা শুরু করে। সেই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ দূত স্যার টমাস রো কে ভারতের সম্রাট পাদিশাহ জাহাঙ্গীরের দরবারে পাঠানো হয়। শর্ত সাপেক্ষে জাহাঙ্গীর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যবসা করার অনুমতি প্রদান করেন। কালক্রমে মূঘল সাম্রাজ্যের দূর্বলতার সূযোগে ১৭১৭ সালে সম্রাট ফররুখশিওরের আমলে তারা কোলকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতানটি এই তিন গ্রামের দেওয়ানী লাভ করে এবং ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ স্থাপন করে বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি শুরু করে। ১৭৫৬ সালে বাংলার সুবাদার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে দ্বন্দে কোলকাতা শহর এবং ফোর্ট উইলিয়াম হারাবার পর কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোলকাতার কাছাকাছি ফুলতায় আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে মাদ্রাজ থেকে আসা কোম্পানির কর্মকর্তা লর্ড ক্লাইভ এর কুটচালে এদেশীয় কিছু দালালের সহায়তায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তীতে বাংলার শাসন পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তাঁরা। ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমকে পরাজিত করে ভারতের পূর্ব অংশের শাসনভার পুরোপুরি গ্রহণ করে এই জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। ধীরে ধীরে প্রায় পুরো ভারত দখল করে নেয় তাঁরা। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষ শাসন করে কোম্পানি। লবন, গন্ধক, তুলা, নীল, রেশম, চা আর আফিমের ব্যবসা করতে আসা কোম্পানি নিজেদের ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকে। এদেশের ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য জারি করে সূর্যাস্ত আইনের মতো বিতর্কিত আইন। নিজেরাই বাট্টার মাধ্যমে শুরু করে নীল এবং আফিম চাষ। আসাম এবং ডুয়ার্সে গড়ে তোলে চা বাগান। এভাবে সামরিক শক্তির সাহায্যে ফুলে ফেঁপে ওঠে পৃথিবীর প্রথম কর্পোরেট জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানির কোলকাতা হেডকোয়ার্টার রাইটার্স বিল্ডিং আজও ব্যবহার হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয় হিসেবে।
এভাবেই শুরু হয় পুঁজিবাজার তথা আধুনিক পুঁজি ব্যবস্থার। সেই সঙ্গে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিরও উদ্ভব ঘটে। এই জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ব্যবস্থা আজও ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতির উপরে।