download (2)

মোবারক হোসেন : দেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার আভাস মিলছে। বিনিয়োগ সমন্বয় জটিলতা কেটে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলের নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে তারা শেয়ার বিক্রির চেয়ে কেনায় মনোযোগ দিয়েছেন। তবে দীর্ঘ দিনের মন্দার পর বেশ কিছু দিন মৌলভিত্তিহীন শেয়ারের অস্থিরতা কাটিয়ে স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত, গত কয়েক দিনের বাজার আচরণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বার্তা বহন করে। এ সময় বাজারগুলো লেনদেনে যেমন একটি অবস্থান ধরে রাখে তেমনি সূচকও লেনদেন ছিল ইতিবাচক।

এছাড়া দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিদেশি বিভিন্ন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারের প্রতি নজর ছিল। তারা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন। গত কয়েক মাস ধরেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বেচার চেয়ে কেনায় মনোযোগী ছিলেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের নেওয়া উদ্যোগেই বিদেশি বিনিয়োগে বেড়েছে। তেমনি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এটি বাজারের জন্য শুভ লক্ষণ। ইতোমধ্যে বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ডিএসইর স্ট্রাটেজিক পার্টনার হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

প্রসঙ্গত, সপ্তাহের তিন কার্যদিবসে দুই পুঁজিবাজার সূচকের কম-বেশি উন্নতি ঘটে। একই সময় লেনদেনেও যৌক্তিক একটি অবস্থান ছিল বাজারগুলোর। এ সময় ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ মূল্যস্তরে পিছিয়ে থাকা মৌলভিত্তিসম্পন্ন খাতগুলোর বেশির ভাগই মূল্যবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাজার আচরণের এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ঈদ উল আযহার পর আরো স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।

বাজার বিশ্লেষনে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক ও বস্ত্র খাতের কারণেই বাজার আজও অনেকটা গতিশীল ছিল। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বাজার আগের তুলনায় বেশ ভালো অবস্থায় আছে। টার্নওভারও বেড়েছে। যদিও এ বছরের শুরুর দিকে যে টার্নওভার ছিল তা নেই। এছাড়া অনেকের হয়তো ধারনা রয়েছে, সূচক এবার ছয় হাজার অতিক্রম করবে। কিন্তু সূচক নিয়ে অযথাই এমন ভাবাটা ঠিক নয়। সূচক দেখারও কোনো বিষয় নয়। আর এখন যে বাজার ভালো হচ্ছে, সেটি সংশ্লিষ্টদের গত দু-তিন বছরের দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল। তাই এই মুহুর্তে বাজার নিয়ে অতি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কেউ যদি তার টাকা দিয়ে উৎপাদনে নেই, কিংবা নানা অনিয়মের কারণে জেড ক্যাটাগরিতে আছে, কিংবা জন্মের পর থেকে ডিভিডেন্ড দেয়নি এমন কোম্পানি কিনেন, সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু বলার থাকে না।

জেড ক্যাটাগরির শেয়ার দর বাড়ার বিষয়ে তারা বলছেন, এসব কোম্পানির দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা আসলে এসব শেয়ার যারা কিনছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর একটি ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন এখন পদক্ষেপ নেওয়ার পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। তবে স্বতন্ত্রভাবে কেউ যদি তার টাকা দিয়ে উৎপাদনে নেই, কিংবা নানা অনিয়মের কারণে জেড ক্যাটাগরিতে আছে, কিংবা জন্মের পর থেকে ডিভিডেন্ড দেয়নি এমন কোম্পানি কিনেন, সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু বলার থাকে না। কিন্তু বিএসইসি এখন বাজারে যে গুজবগুলো রটানো হতো, সেগুলো থেকে হয়তো কিছুটা রেহাই পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। যা বাজারের জন্য বেশ ইতিবাচক হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নির্ভয়ে কোম্পানির ভালো মন্দ সব কিছু প্রকাশ করে দিচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠন করতে কাজ করছে বিএসইসি। স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠন করার জন্য ভালো বিনিয়োগকারী প্রয়োজন। এই বিনিয়োগকারী তৈরি করার জন্য দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছে পুঁজিাজার। কারণ ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে সমস্যা হওয়ার পর বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংস্কার হয়েছে আমাদের পুঁজিবাজারে। কোন কোন জায়গায় সমস্যা, সেই বিষয়গুলো আমরা শনাক্ত করেছি। ওই আলোকে কাজ করছে কমিশন। ওই সংস্কারের সুফল পেতে শুরু করেছে বাজার। এখন চাইলেই কেউ আগের মত কারসাজি করতে পারবে না।

এম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী নুরুল আজম বলেছেন, বর্তমান পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। বাজার তার আপন গতিতে চলছে। তেমনি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। বাজারের এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে লেনদেন আরো বাড়বে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা করা সম্ভব।

এমেস সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে বর্তমানে বিনিয়োগের উত্তম সময়। বিনিয়োগকারীরা বুঝে শুনে বিনিয়োগ করলে লোকসানের সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কোম্পানি সর্ম্পকে জেনে শুনে বিনিয়োগ করা উত্তম। বাজারে এখনো অনেক রুগ্ন কোম্পানি আছে যাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনা খুবই ভাল। ঐ সব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে ভাল মুনাফা করা সম্ভব।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়া নিয়ে সরকারের ইচ্ছার কোনো কমতি নেই। অর্থমন্ত্রী ২০১১-১২ সালে মিটিং করে ব্যাংকগুলোকে আসার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু একমাত্র রূপালী ছাড়া বাকি তিনটি ব্যাংকই পুঁজিবাজারে আসার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেও মার্কেটে আসেনি। আর তাদের না আসার পেছনে দুই ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে। একটি হচ্ছে, মার্কেটে আনার জন্য যে ধরনের টেকনিক্যাল ক্যাপাসিটির প্রয়োজন তাতে ঘাটতি আছে। অন্যটি হচ্ছে, তারা আসতে ভয় পায়। তারা মনে করছে, এতে তাদের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে হবে। হয়তো রিপোর্টিং কমপ্লায়েন্স অনেক বাড়াতে হবে। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা যোগ হবে। এগুলোকে তারা ঝামেলা মনে করছে। পুঁজিবাজারে না আসা ব্যাংকের এজিএম ঠিকই হয়, সব এজেন্ডাও পাস হয় কিন্তু সেখানে কোনো শেয়ারহোল্ডার না থাকায় কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। অথচ যারা পুঁজিবাজারে আছে, তাদের অনেক ধরনের প্রস্তুতি ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ফলশ্রুতিতে তারা পুঁজিবাজারে আসতে চাচ্ছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে খুব দৃঢ়চেতা হতে হবে। কারণ আমাদের আমলাতন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনলে এসব কোম্পানিকে বাজারে আনা যাবে না। আর পুঁজিবাজারে এলে তাদের অনেক জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হবে। আজকাল নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর অনেক প্রশ্ন করছেন। এমনকি সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে সরকারি চাকরিজীবী বা আমলারা মনে প্রাণে চাইছেন না পুঁজিবাজারে এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হোক। কিন্তু পুঁজিবাজারের ভালো কোম্পানিগুলোকে যদি তালিকাভুক্ত না করা হয় তাহলে বিনিয়োগ না আসার পাশাপাশি বাজারে গভীরতাও বাড়বে বলে মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।