bank

মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তি হিসেবে খ্যাত ব্যাংকিং খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে গত তিন মাসে এ খাতের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। তাছাড়া অর্ধবার্ষিকে অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ার প্রতি আয় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। এর ফলে বছর শেষে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা আগের তুলনায় বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে যা এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তবে বর্তমান বাজার স্থিতিশীল আচরণ করায় ব্যাংক খাতের সুদিন ফিরে আসছে। বেশ কিছুদিন ধরেই খাতটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। এরই অংশ হিসেবে বাড়ছে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর ও লেনদেন। সম্প্রতি পুঁজিবাজারের সব খাতে লেনদেন বেড়েছে। তবে সবচেয়ে এগিয়ে ব্যাংকিং খাত।

অর্ধযুগ পর পুঁজিবাজারের রাজত্বে ফিরেছে ব্যাংক খাত। গত জুন মাস থেকে প্রায়দিনই বাড়ছে এ খাতের শেয়ারের দাম। একই সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও। ফলে জুনের মতো জুলাই মাসেও লেনদেনের শীর্ষে থাকার তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল রেখেছে ব্যাংকিং খাত। আর এ খাতের উত্থানের ফলে ইতিবাচক ধারায় হাঁটছে দেশের পুঁজিবাজার।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষে থাকার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলো ব্যাংক খাত। এর আগের মাস জুনেও দ্বিতীয় স্থানে ছিলো ব্যাংক খাত। শুধু তাই নয়, বিদায়ী অর্থবছরের দ্বিতীয় স্থানে ছিলো ব্যাংক খাত।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং তালিকাভুক্ত ত্রিশ ব্যাংকের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংক আগের বছরের তুলনায় ভালো মুনাফা করেছে। কোম্পানিগুলোও শেয়ারহোল্ডাদের ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে। এছাড়াও যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে কম দামে শেয়ার কিনতে পারায় বিনিয়োগকারীদের নজর এখন ব্যাংক খাতে।

তারা বলছেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতি কেমন হবে এই বিষয়টা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা ভয় ছিলো যে মুদ্রানীতি পুঁজিবাজারবান্ধব হবে কি না? কিন্তু গত ২৬ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে এই ভয়টা কেটে গেছে। ফলে জুলাইয়ে শেষ কয়দিন এমনকি আগস্ট মাসের তিন কার্যদিবসই বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়েছে। এ কারণে প্রায় সব খাতের শেয়ারের দাম কমার পরও ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ছিলো দেশের পুঁজিবাজার।

তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা নতুন করে ব্যাংক খাতের শেয়ারের দিকে ঝুঁকছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন পর বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ার দর। সাধারনত তিন কারনে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। গতকাল পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এমনই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের প্রতিবেদকের কাছে।

তারা বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের খাতের শেয়ারের প্রতি কদর বাড়ছে। সামনে আরো বাড়বে। কারণ অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর কাছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি রয়েছে ব্যাপক আস্থা। যদিও পুঁজিবাজারের মন্দা সময়ে এ খাতের প্রতি আস্থা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আবার এ খাতের শেয়ারের প্রতি ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা জানান, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি বাড়াতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এ খাতের শেয়ার এখনো কিছুটা বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত। পাশাপাশি রয়েছে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ আস্থাভাজন।

তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা আরো জানান, ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন এবং শেয়ার সংখ্যা বেশি। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এ খাতকে বিনিয়োগ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আবার কোম্পানিগুলোর লেনদেন ও দর ওঠানামা অনেকটাই স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। অন্যান্য কোম্পানির মতো ঢালাওভাবে এ খাতের শেয়ার দর উত্থান-পতন হয় না। কয়েক বছর ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বেশি মুনাফা দিতে পারেনি এ খাতের কোম্পানিগুলো। তারপরও অন্যান্য খাতের চেয়ে ভালো ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

পুঁজিবাজারের পতনের সময় বিনিয়োগকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে এ খাতে বাজার সেলপ্রেসার বেশি হয়েছিল। পাশাপাশি প্রফিট টেক করেছে, যার প্রভাব পড়েছে পুরো খাতের ওপর।

কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজার স্বাভাবিক গতিতে চলছে। বাজার একটানা যেমন বাড়ছে না, তেমনি বাজার একটানা দরপতন ঘটছে না। এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংক খাতের শেয়ার ধারণ বা বিনিয়োগ করতে হবে। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়লে পুরনো লেনদেনের চমকে ফিরে আসবে বলে জানান তারা।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, বছর শেষে সোমবার পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ৩০ কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২৮ টি কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে। এছাড়া অপরিবর্তিত ছিল ২ কোম্পানির শেয়ারের দর। শতাংশের হিসাবে যার পরিমাণ ৯৫ শতাংশ।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এই বছর ব্যাংকের শেয়ারের দর বৃদ্ধির প্রধান কারণ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সমন্বয় ও অধিকাংশ ব্যাংক কোম্পানি মুনাফায় ফেরা। এই দুই কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এই খাতের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। এবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সময় ও বিশেষ সুযোগে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আইনী সীমায় নামিয়ে আনে ১৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

ডিএসই’র তথ্য মতে, জুলাই মাসে ডিএসইতে মোট ৬৫৯ কোটি ২৩ লাখ ৮ হাজার শেয়ার কেনা-বেচার মাধ্যমে ২০ হাজার ৯২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার লেনেদেন হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের অবদান ছিলো- ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যা টাকার অংকে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৭৪ কোটি ৬৩ লাখ ৯ হাজার টাকা। ফলে খাতওয়ারি ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষে থাকার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

এই খাতের চেয়ে ৪৯৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা বেশি লেনদেন হওয়া জুলাই মাসে শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে টেক্সটাইল খাত। ৪৮টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত এই খাতে ১৫৫ কোটি ৪৩ লাখ শেয়ারে হাতবদলের বিনিময়ে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ৫৬ লাখ ৫ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। যা শতাংশের হিসেবে ডিএসই’র মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ফলে কয়েক বছর পর লেনদেনের শীর্ষে স্থানে উঠে এসেছে বস্ত্র খাত।

বিদায়ী মাসে ২ হাজার ৩০৮ কোটি ৯৯ লাখ ২ হাজার টাকা লেনদেন হওয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং খাত। ডিএসইতে এ খাতের অবদান ১১ শতাংশ। এ ছাড়াও দুই হাজার ২৯১ কোটি ৪১ লাখ ৫ হাজার টাকা লেনদেন হওয়ায় চতুর্থ স্থানে ফার্মাসিউটিক্যালস খাত। যা শতাংশের হিসেবে ডিএসইতে অবদান ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

অন্যদিকে ডিএসই’র মোট ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ লেনদেনের ফলে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ফুয়েল অ্যান্ড পাওয়ার খাত। এ খাতে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮৪ কোটি ৭৮ লাখ ৫ হাজার টাকার। আর ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ পরিমাণ লেনদেন হওয়ায় ষষ্ঠ স্থানে উঠেছে আর্থিক খাত। ২৩টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত এই খাতে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি আগেও বলেছি যে, ব্যাংকিং খাতের কিছু সমস্যা ছিল। তবে কিছুদিন আগে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ সমন্বয় করায় এখন সে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আশা করছি, বিনিয়োগকারীদের এখন এ শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। তবে এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। তারা যদি এসব শেয়ারের দিকে নজর দেন, তবেই খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

একই প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের একটি শক্তিশালী খাত হলো ব্যাংকিং। বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন এ খাতের সার্বিক অবস্থা ভাল না থাকলেও বর্তমানে চিত্র বদলাতে শুরু করছে। ভবিষ্যতে এ খাতের অবস্থা আরও ভাল হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

ডিএসইর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ব্যাংক হচ্ছে পুঁজিবাজারের সবচেয়ে শক্তিশালী খাত। তবে ব্যাংকের অনিয়মসহ নানা কারণে এ খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, এখন সে চিত্র বদলে গেছে। দেখেশুনে বিনিয়োগ করলে এখান থেকে ভাল কিছু আশা করতে পারেন শেয়ারহোল্ডাররা। তবে বিনিয়োগ হতে হবে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী।