dse-cse

\দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: যেকোন বিষয়ে অনিয়ম হলে এর বিপরীতে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম দ্রæত শেষ হবে- এমন প্রত্যাশা সবারই থাকে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি কিংবা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট যে কারো বিরুদ্ধে কারসাজি কিংবা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব্য।

কারণ এতে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ বিেিয়াগকারীর ভাগ্য জড়িত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে বিষয়টি, তা হলো বাজার তথা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার বিষয়টি। যদি বিনিয়োগকারীরা বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে তা বাজারের অস্থিতিশীলতার মূল নিয়ামক হয়ে ওঠতে পারে।

দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে তদন্তের নামে কালক্ষেপন একটি নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ্যাৎ তদন্ত শব্দটি নতুনরুপে ‘ত-দ-ন্ত’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, পুঁজিবাজারে অনিয়মে বিপরীতে গঠিত কমিটির তদন্ত কার্যক্রম। আর এ কারণেই কারসাজি কিংবা আইন লঙ্ঘণ করে কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাড়ি বোঝাই করলেও বরাবর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারে আস্থার সঙ্কটেরও সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক উর্ধ্বমূখী পুঁজিবাজারে দুর্বল ভিত্তির সাত স্বল্পমূলধনী ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির নেপথ্যে কোনো কারসাজি হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। গত ২২ ডিসেম্বর এ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

কমিটি যে কোম্পানিগুলোর দরবৃদ্ধি খতিয়ে দেখবে সেগুলো হলো- জিলবাংলা সুগার মিলস, শ্যামপুর সুগার মিলস, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, মেঘনা পিইটি, ইমাম বাটন, ফাইন ফুডস ও বিডি অটোকারস লিমিটেড। স্বল্পমূলধনি এ কোম্পানিগুলোর কেউই নিজ নিজ ব্যবসায় ভালো করছে না। দু-একটি কোম্পানি নামমাত্র মুনাফা দেখালেও তাদের আর্থিক শক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ নিরীক্ষকেরও। আর্থিক দুর্বলতার নানা দিক নিয়ে কোম্পানির নিরীক্ষকও নিজ নিজ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে শেয়ারহোল্ডারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

কমিটি গঠনের পর পেরিয়ে গেল সাত মাসেরও বেশি সময়। অথচ এখানে কোন কারসাজি হয়েছে কি-না তা সিকিটিও জানতে পারেনি বিনিয়োগকারীরা। তার ওপর নতুন করে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচ কোম্পানি। সম্প্রতি বিএসইসির পক্ষ থেকে নতুন করে আরও ৫ কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ফলশ্রুতিতে লোকসানের বোঝাটাও বিনিয়োগকারীদের কাধেই চেপে বসেছে। কারণ এসব কোম্পানিকে নিয়ে যদি সত্যিকার অর্থেই কোন অসাধু চক্র কারসাজি করেই থাকে, তবে তারা নিশ্চয় আর এসব শেয়ারে সম্পৃক্ত থাকবেন না। বরং এসব কোম্পানির শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে গুজে দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে।

বিনিয়োকারীরা অভিযোগ করে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার পর এরমধ্যে কয়েকটি শেয়ারের দর আশঙ্কাজনক হারে কমেছে, আবার কিছু শেয়ার আকাশচুম্বীও হয়েছে। তার মানে এই না যে, তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তটি ভ‚ল ছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি গঠনের পর যে দীর্ঘ সময় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে সেটি অন্যায়।

তারা আরও বলেন, শুধু এসব কোম্পানি-ই নয়, প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন নিয়মে বিএসইসি কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে এ ধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর অগ্রগতি কিংবা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে রয়ে গেছে।

তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০১৬ সালে লোকসানি হওয়া সত্বেও জিলবাংলা সুগারের শেয়ার দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল। বছরের প্রথমদিকে এ নিয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে তদন্ত সাপেক্ষে কি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?

যদি হয়েই থাকে তবে তা কেন প্রকাশ করা হলো না? আর যদি কোন অনিয়মই না হয়, তাও কেন প্রকাশ করা হয়নি? কাজেই এখানে স্বচ্ছতা কতুটুকু নিশ্চিত হয়েছে- বিএসইসির কর্তা-ব্যক্তিদের কাছে এমন প্রশ্নই রেখেছেন তারা।

রহিমা ফুডের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি- মন্তব্য করে বিনিয়োগকারীরা জানান, কোম্পানিটি যদি কোন তথ্য গোপন করে থাকে কিংবা শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যদি কোন আইনের লঙ্ঘণ করে তবে তা দ্রæত বিনিয়োগকারীদের সামনে আনা হচ্ছে না। অথচ তদন্ত কমিটি গঠনের পরও প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এর কোন অগ্রগতি হয়নি।

জানা গেছে, মালিকানা পরিবর্তন ইস্যুতে রহিমা ফুডের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ অক্টোবর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিএসইসি। এজন্য সময় বেধে দেয়া হয়েছিল ৩০ দিন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তদন্ত কার্য সম্পন্ন না হওয়ায় আরও ১০ দিন সময় বাড়ানো হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও এর কোন অগ্রগতিই বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়নি। এতে দু-টানায় পড়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা।

সুমন আহমেদ নামে রহিমা ফুডের এক বিনিয়োগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোম্পানি যদি কোন অন্যায় করে থাকে তাহলে তার বিচার হউক এটা আমরাও চাই। আর যদি না করে তবে শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি দিয়ে দেয়া উচিত। ভাল-খারাপ কিছুতো একটা জানাতে হবে। এভাবে আমাদের ঝুঁলিয়ে রাখার মানে কি?

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে বর্তমান কমিশনের সুদক্ষতায় বাজার আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে বিএসইসি যে সংস্কার কর্মসূচীর বাস্তবায়ন করেছে, তা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভ‚মিকা রাখছে। তবে উর্ধ্বমূখী এ বাজারে বিদ্যমান আইন-কানুন সঠিকভাবে পরিপালনসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে বাজার আবারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠতে পারে। কাজেই বিএসইসিকে এ বিষয়ে আরও মনযোগী হতে হবে বলে তারা মনে করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিএসইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিএসইসি সবসময়ই বিনিয়োগকারী ও বাজারের স্বার্থে কাজ করে। তবে লোকবল সঙ্কটে অনেক কিছুই যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হয় না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন আচরণে আমরা বরাবরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যখনই কোন কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন ওই শেয়ারে বিনিয়োগ করেন তখনই স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিএসইসির দায়িত্ব্যবোধের পরিচায় পাওয়া যায়।

নামমাত্র কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ও তদন্ত কমিটি গঠন করে তারা তাদের দায়িত্ব্য শেষ করে থাকে। এতে সুযোগ সন্ধানীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে ফেলে। তিনি বিএসইসির নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা যদি সত্যিই বাজারের ভালো চান এবং বিনিয়োগকারীবান্ধব হয়ে থাকেন তবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করুন। আমরাও চাই অন্যায়ের বিচার হোক। তবে তা বিনিয়োগকারীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।