lawএইচ কে জনি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রায় ছয় বছর আগে বিদ্যমান কোম্পানি আইনকে সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিলেও অদ্যাবধী তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অথচ বিদ্যমান ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অযোগ্য। আইনটির বিভিন্ন ধারার মধ্যে অনাবশ্যক দ্ব›দ্ব রয়েছে।

পুঁজিবাজারের আইনের সঙ্গেও রয়েছে বৈপরীত্য। আর এসব কারণেই বিশ্ব ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) কোম্পানি আইনের একটি খসড়া দুই বছর পূর্বে জমা দিলেও তা চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বর্তমান সরকারের শুরুর দিক থেকেই কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ চলছে। শুরুতে সরকার অবশ্য দ্বিধায় ছিল, বিদ্যমান কোম্পানি আইন সংশোধন করবে, নাকি নতুন আইন পাস করবে। সংশোধনের জন্য দুই বছর কাজ করার পর ২০১১ সালের জুলাইতে হঠাৎ তৎকালীন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন নিজেকে আহŸায়ক করে সিদ্ধান্ত নেন যে নতুন কোম্পানি আইন হবে। তারপরও ছয় বছর কেটে গেছে।

নতুন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভাতেই পাঠাতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিই বলছে, বিদ্যমান কোম্পানি আইনটি অনাধুনিক এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অযোগ্য। আইনটির বিভিন্ন ধারার মধ্যে অনাবশ্যক দ্ব›দ্ব রয়েছে। পুঁজিবাজারের আইনের সঙ্গেও রয়েছে জটিলতা।

এতে এমন কিছু অবাঞ্ছিত ধারা রয়েছে, যাতে মানুষের অহেতুক হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আইনটির এক ধারার সঙ্গে আরেক ধারা বিপরীতমুখী ও দ্ব্যর্থবোধক। তাই আইনটি নতুন করে করা জরুরি।

তবে আইনজীবীদের দিক থেকে নতুন আইন প্রণয়নের বিরোধিতা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ, বিদ্যমান আইনে কোনো কিছু হলেই আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। নতুন আইনে সেই সুযোগ রাখা হচ্ছে না।

বিদ্যমান কোম্পানি আইনের ওপর এসব মতামত দিয়েছে খোদ যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম মর্তুজা রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি দীর্ঘ দিন ধরেই কোম্পানি আইন সংশোধনের ব্যাপারে কাজ করছে। আরজেএসসি এতে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে।

আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রচলিত বিধান, স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, হয়রানি লাঘব, শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করা ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

কোম্পানি আইন সংশোধন করে এতে কিছু নতুন ধারা সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে আরজেএসসি। বলেছে, প্রত্যেক কোম্পানিতে একজন করে নিরপেক্ষ পরিচালক, কোম্পানি সচিব ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক থাকতে হবে, বর্তমানে যা নেই।

পরিশোধিত মূলধন দুই কোটি টাকা হলেই কোম্পানির বিধিবদ্ধ সেক্রেটারিয়াল রেকর্ড নিয়মিত নিরীক্ষণ করাতে হবে, মূল্যায়নের জন্য কোম্পানি যা পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করবে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এ রকম বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আর পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা হলে কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোম্পানি সচিব থাকতে হবে, যাঁরা হবেন আইসিএসবির সদস্য।

নিরপেক্ষ পরিচালকের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি হবেন একজন অনির্বাহী পরিচালক, কোম্পানিতে যার কোনো ঋণ বা মালিকানা নেই এবং অর্থ, বাণিজ্য বা আইন বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন ও সমাজে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে যাঁর সুনাম আছে।
কোম্পানির গঠন পদ্ধতির বিষয়েও সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বর্তমানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গঠন করতে পারলেও এটা হওয়া দরকার এক বা একাধিক ব্যক্তি। তবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে সাত বা ততোধিক ব্যক্তিই থাকবেন।

কোম্পানির সংঘস্মারক মুদ্রিত হতে হয় এবং এতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের ঠিকানা ও পরিচয় দুজন সাক্ষীর সামনে স্বাক্ষর করতে হয়। আরজেএসসি বলছে, এসবের পাশাপাশি অনলাইনে সংঘ-স্মারক দাখিল ও স্বাক্ষর স্ক্যান করায় বাধ্যবাধকতা আনা দরকার। আর, যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আদালতের পরিবর্তে ক্ষমতা দেওয়া দরকার সরকারকে।

এজিএম বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানির কার্যালয় নিবন্ধিত হয়েছে যে শহরে, সেই শহরে এজিএম হতে হবে এবং এজিএমে বা অন্য কোথাও কোম্পানির পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনোরূপ উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ বা খাদ্যদ্রব্য দেওয়া যাবে না। তবে হালকা আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে পারে।

কোনো কোম্পানি এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে ওই কোম্পানি ও কোম্পানির প্রত্যেক কর্মকর্তাকে অনধিক ১০ হাজার টাকা এবং প্রতিদিনের দেরির জন্য ২৫০ টাকা অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই অঙ্ক যথাক্রমে ৫০ হাজার ও এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

যেসব প্রাইভেট কোম্পানি ব্যবসা শুরু করার প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করবে না, তারা ব্যবসাই করছে না বলে বিবেচিত হবে। নিবন্ধক তাঁর নিবন্ধন বই থেকে এসব কোম্পানির নাম কেটে দেবেন- এ প্রস্তাবও করা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে ‘শেয়ারের প্রকৃতি’ শিরোনামের ধারায় বলা হয়েছে, ‘শেয়ার-মূলধন রয়েছে, এমন কোম্পানির প্রত্যেক শেয়ার যথোপযুক্ত সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত থাকবে।’

আরজেএসসি বলেছে, শুধু এটুকু বললে ডিপোজিটরি আইনের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। এর সঙ্গে আরও বলতে হবে, ‘তবে এই ধারা ডিপোজিটরিতে অন্তর্ভুক্ত শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’

বর্তমানে প্রত্যেক কোম্পানিকে ১২ বছরের হিসাব বই ও ভাউচার সংরক্ষণ করতে হয়। আরজেএসসির মতে, এই ধারাটি অবাঞ্ছিত, অতিরিক্ত ও একেবারেই অনভিপ্রেত। বরং ছয় বছর পর্যন্ত রাখলেই চলবে। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে অনলাইনে দাখিল করা কোনো কিছু আরজেএসসি সংরক্ষণ করবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর।

জানা যায়, খসড়ায় পুঁজিবাজার রক্ষায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহজতর করাসহ সম্প্রসারিত নতুন নতুন ব্যবসাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খসড়া তৈরিতে দেড় কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক বেশি স¤প্রসারিত হওয়ায় আর পুঁজিবাজারও কোম্পানি আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু বিদ্যমান ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন এসব বিষয় সামাল দিতে পারছে না। বিধায় প্রণীত খসড়ায় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য কোম্পানি আইনে ‘বাইব্যাক’ বা শেয়ার পুন:ক্রয়ের বিধান রাখা হয়েছে।

এ আইনে কোন কোম্পানি তার মোট পরিশোধিত মূলধন ও উদ্বৃত্ত তহবিলের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার বাইব্যাক করতে পারবে না। তবে এক আর্থিক বছরে ওই বছরের মোট পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি বাইব্যাক করতে পারবে না। এছাড়া এ ধারার কোন বিধান লঙ্ঘন করলে ওই কোম্পানি দোষী সাব্যস্ত হবে এবং ৫ লাখ টাকা আর্থিক দন্ডে দন্ডিত হবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কর্তৃক চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে বাইব্যাক পদ্ধতি সম্পন্ন করতে হবে। বাইব্যাক সম্পন্ন করার ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ক্রয়কৃত সিকিউরিটিজ বাতিল বা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। নতুন এ আইনে মনোনীত পরিচালকদের শেয়ার কেনার অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে।

একক মালিকানাধীন বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির জন্য এজিএম না করার বিধান থাকছে এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অনিয়ম হলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কোম্পানি আইনে আদালতের সম্পৃক্ততা যতটা সম্ভব কমানো হচ্ছে। আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ ও ফার্মসকে (আরজেএসসি)।

এ ছাড়া খসড়ায় একক মালিকানাধীন কোম্পানিকে এ আইনের আওতায় আনা, পরিচালকদের দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ, অনুমোদিত মূলধনের সুযোগ না রাখা, লভ্যাংশ পরিশোধে বিধি-নিষেধ আরোপ,কোনো ধরনের আপত্তি না জানানোর বিধান রাখা ও বিকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রও স্পষ্ট করা হচ্ছে।

খসড়ায় অনিয়মের দায়ে নিরীক্ষকের লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদÐের বিধানসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে করপোরেট গভর্নেন্স বা কোম্পানির সুশাসন নিশ্চিত করার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশে প্রচলিত কোম্পানি আইনের মতো এতো দুর্বল আইন বিশ্বের কোথাও নেই। বৈশ্বিক বাণিজ্য-ব্যবস্থায় এ আইন অচল। সংশোধন না করে তাই একটু সময় লাগলেও এটি নতুনভাবে করা উচিত। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে যেসব কেলেঙ্কারির কথা শোনা যাচ্ছে, তার পেছনেও এই আইনেরই দুর্বলতা রয়েছে বলে তারা মনে করেন।

তাদের মতে, কোম্পানির সব দলিলপত্র অনলাইনে দাখিল করার সুযোগ ও পরিচালকদের মাধ্যমে শেয়ার কিনে নেওয়ার বিধান (বাই-ব্যাক) না থাকা, পরিচালকদের সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারিত এবং কোম্পানি সচিবের অস্তিত্ব না থাকা বিদ্যমান আইনের অন্যতম দুর্বলতা। তারা জানান, বিদ্যমান আইনের আওতায় কোম্পানিতে সুশাসন বজায় রাখা অবাস্তব। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) যে করপোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইন করেছে, সেটিও অসম্পূর্ণ। তারা মনে করছেন, আইনের দায়সারা সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে কারও কোনো লাভ হবে না।

প্রসঙ্গত, নতুন কোম্পানি আইনের একটি খসড়া তৈরি করতে ২০১১ সালের জুলাই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. গোলাম হোসেনকে প্রধান করে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। এরপর আইএফসি’র সহায়তায় বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ফান্ড এ আইনের খসড়া তৈরি করেছে।

এ জন্য কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব-উল আলমকে প্রধান কনসালটেন্ট নিয়োগ করে সংস্থাটি। এর বাইরে কানাডার সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৯ বছর কাজ করা রিচার্ড শ’সহ দেশি-বিদেশি আরো কয়েকজন কনসালটেন্ট কাজ করেছেন। আইএফসি একটি খসড়া ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসের ২য় সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কাছে জমা দেয়।

আইএফসি’র একটি সূত্র জানিয়েছেন,সরকারের শেষ দিকে খসড়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়া হলেও ২য় মেয়াদের ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রীর এ ব্যাপারে তেমন কোন সাড়া না থাকায় এটি ঝুলে আছে। তিনি আন্তরিক হলেই এটি মন্ত্রি পরিষদ সভায় অনুমোদনের পর তা চূড়ান্ত করা হবে বলে তিনি জানান।