rupali bank lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ারের দর কোন কারন ছাড়াই টানা বাড়ছে। ফলে এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি বাজারে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পড়েছে রূপালী ব্যাংকের। এরকম নানামুখী গুজবে শেয়ারের দর টানা বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন টানা দর বৃদ্ধির পরও কোম্পানিটির উপর কোন নজরধারী নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ব্যাংক খাতের রূপালী ব্যাংক লিমিটেড নিয়ে ভিত্তিহীন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে। তবে এসব খবরের উপর ভিত্তি করে কোম্পানিটির শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যদিও কোম্পানি কর্তৃপক্ষের দাবী, যে খবর ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে তা সম্পূর্ণ গুজব। ব্যাংকটির নাকি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, এমনকি মতিঝিলে রুপালি ব্যাংকের ২২ তলা টাওয়ার হবে। এরকম নানামুখী গুজব।

এদিকে দ্বিতীয় প্রান্তিক ছাড়া মূল্য সংবেদনশীল তথ্য সম্পর্কিত আর কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। শেয়ারদর বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের চিঠির জবাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে রুপালী ব্যাংকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমার দৃষ্টিতে শেয়ারের দর বাড়ার বা কমার কোন কারন আমাদের জানা নেই। তবে কিজন্য বাড়ছে তা আমরা বুঝি না। ফেসবুকে আমাদের কোম্পানি সম্পর্কে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। গুজব হিসেবে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এর সাথে কোম্পানির কোন সম্পর্ক নেই। আমরা বিষয়টি বিএসইসি, ডিএসই এবং সিএসই-কে জানিয়েছি। তবে কারা এ গুজব ছড়াচ্ছে তা আমরা ধরতে পারি নাই।

এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো: রহুল আমীন আকন্দ দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে ইদানিং হরহামেশা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ কোম্পানিটির শেয়ার নিয়েও গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলেছে, এসব গুজব ভিত্তিহীন। পরিস্থিতি বিবেচনায় বোঝা যাচ্ছে শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে। এ অবস্থায় সাধারন বিনিয়োগকারীর স্বার্থে কোম্পানির লেনদেন নজরদারীতে রাখা উচিত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে এক প্রকার জুয়া খেলা (গ্যাম্বলিং) চলছে। তবে এবার ছোট বাজারে ছোট আকারে হচ্ছে। যে সব কোম্পানির দাম বাড়ার কথা, সে সব কোম্পানির দাম না বেড়ে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির দাম বেড়েই চলছে।
কয়েক দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, যে সব কোম্পানি সার্কিট ব্রেকারে পৌঁছেছে, তাদের দাম এত বেশি বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে এসব কোম্পানি নিয়ে বাজারে বিভিন্ন গুজব রয়েছে বলে জানান তিনি। আর কিছু কিছু বিনিয়োগকারী গুজব শুনে ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এ ব্যাপারে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহাম্মাদ মুসা বলেন, লেনদেন বাড়ার বিষয়টি বাজারের জন্য ইতিবাচক। তবে হঠাৎ করে বিশেষ কিছু কোম্পানির দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া বাজারের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন তিনি। কেননা একটি চক্র এসব কোম্পানি নিয়ে কারসাজির আশ্রয় নিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

rupali bank 3 monthঅনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী গত তিন মাসে রূপালী ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েছে সোয়া দুই গুণেরও বেশি। গত ২২ মে এ কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ২৪.৮০ টাকা। সর্বশেষ কার্যদিবসে (১০ আগস্ট) শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ৫৮.৬০ টাকায়। আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির দর বেড়েছে ১৩৬.২৯ শতাংশ বা ৩৩.৮০ টাকা।

সর্বশেষ কার্যদিবসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৯.৯৪ শতাংশ বা ৫.৩০ টাকা এবং সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৫৮.৬০ টাকা দরে। এর দর বাড়ার কোন যুক্তিকতা নেই বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। এদিকে অস্বাভাবিক দর বাড়ার বিষয়টি নজর পড়েছে বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টদের।

যে কারনে রুপালী ব্যাংকের এর কাছে শেয়ার দর বাড়ার কারন ও জানতে চায় স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ডিএসই কর্তৃপক্ষের চিঠির জবাবে কোম্পানি জানিয়েছে, এ দরবৃদ্ধির নেপথ্যে কোনো অপ্রকাশিত মূল্যসংবেদনশীল তথ্য নেই। তবে প্রশ্ন হলো কি কারনে দর বাড়ছে সিএমসি কামালের এর কারন খুঁজতে বের হয়েছেন দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানী টিম।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, রুপালী ব্যাংকের শেয়ার দর বাড়ার কোন কারন নেই। একটি চক্র বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর বাড়াচ্ছে। এ গুজব চক্রটি বাজারে গুজব ছড়াচ্ছে যে এ শেয়ারের দর সামনে আরো বাড়বে। বৃহস্পতিবার ডিএসই মতিঝিল ভবনে একাধিক সিকিউরিটিজ হাউস ঘুরে বিনিয়োগকারীদের বলতে শোনা যায়, সিএমসি কামালের শেয়ারের দর আরো বাড়বে।
তবে কি কারনে বাড়বে তারা বলতে পারছেন না। তারাও গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনছেন। তবে কোম্পানিটির শেয়ারের দরবৃদ্ধির দৌরান্তে গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ পোশন করছেন বিনিয়োগকারীরা। কেউ বলতে পারছেন না যে এই শেয়ারের দরবৃদ্ধির পেছনে কোনো মুল্য সংবেদনশীল তথ্য রয়েছে কিনা।

এদিকে আগের বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের মুনাফা বেড়েছে ০.৩৮ টাকা। আর এতেই পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকটির শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমনকি তিন মাসে শেয়ারটির দর বেড়েছে সোয়া দুই গুণেরও বেশি। বর্তমানে এ শেয়ারটি লেনদেন হচ্ছে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরে।

অর্ধবার্ষিকের শেয়ারপ্রতি আয় এবং শেয়ারের বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ৪০ ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে লোকসান করায় পিই রেশিও ঋণাত্বক। আর পিই রেশিও বিবেচনায় ব্যাংকটির শেয়ারে এখন বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মূল্য আয়ের অনুপাত বা পিই রেশিও ১৫ থেকে ২০ পর্যন্ত অনেকটা নিরাপদ। পিই রেশিও এর উপরে যত উঠবে ঝুঁকি ততই বাড়বে। অন্যদিকে ৪০ পর্যন্ত পিই রেশিও নিরাপদ মনে করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর উপরের পিইধারী কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য মার্জিন ঋণ প্রদানে সংস্থাটির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তাই নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি বাছাই করার ক্ষেত্রে পিই রেশিও হলো সর্বোচ্চ মাপকাঠি। এছাড়াও কোম্পানির মুনাফা, শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের পরিমাণ বা এনএভিপিএস, নগদ কার্যকরি নীট প্রবাহ বা এনওসিএফপিএস, ডিভিডেন্ডের হার ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।

দেখা গেছে, সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ৪.৩৯ টাকা লোকসান করে রূপালী ব্যাংক। তবে চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকেই ধারাবহিকভাবে মুনাফা বাড়ছে ব্যাংকটির।

চলতি হিসাব বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে ব্যাংকটি শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) করে ০.৪২ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ০.২৫ টাকা। আর দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন’ ১৭) ইপিএস করে ০.৩১ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ০.০৯ টাকা। এদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিক মিলে অর্ধবার্ষিকে (জানুয়ারি-জুন’ ১৭) ইপিএস করে ০.৭৩ টাকা, যার এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ০.৩৫ টাকা।

তথ্য মতে, অর্ধবার্ষিক ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকহারে বাড়তে থাকে। আর অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে গত ৩ জুলাই কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে শোকজ করে ডিএসই। আর শোকজের জবাবে ৪ জুলাই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জানায়, শেয়ারদর বাড়ার মতো মূল্যসংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই।

অর্থাৎ কোনো কারণ ছাড়াই শেয়ারটির দর, লেনদেনের পরিমাণ এবং শেয়ারের হাতবদল অস্বাভাবিকহারে বাড়ছে। অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বর্তমানে শেয়ারটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। একই সঙ্গে পিই রেশিও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া রাষ্ট্রয়াত্ত রুপালী ব্যাংকে অনুমোদিত মূলধন ৭০০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ৩০৩ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৫৯৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে।

সর্বশেষ ২০১৬ সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ স্টক ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ রয়েছে সরকারের হাতে। বাকী শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ রয়েছে।