shanara abdullahদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ফজরের নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিন্টো রোডে আমাদের বাড়ির কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে আর্মিরা। রুমের মধ্যে ঢুকে সবাইকে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাত ওপরে তুলে নেই। তারা সিঁড়ি দিয়ে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মৃত্যুর আগে আমার শিশুসন্তান সুকান্ত বাবু বলছিল- মা, আমাকে কোলে নাও। আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি।

বুকভরা হাহাকার নিয়ে কলাগুলো বলছিলেন ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ সুকান্ত বাবুর মা শাহনারা বেগম। গত বুধবার বরিশাল প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনাসভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন তিনি।

এ সময় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তাঁর স্বামী ও শহীদ সুকান্ত বাবুর বাবা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্র বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বরিশাল প্রেস ক্লাবের সভাপতি কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল।

স্মৃতিচারণাকালে আবেগতাড়িত কণ্ঠে শাহনারা বেগম বলেন, ২৭ নম্বর মিন্টো রোডে আমার শ্বশুর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় থাকতাম আমরা। ওই দিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আজানের পরপরই গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে আমার।

তখন বাইরের পরিবেশটা ছিল আলো-আঁধারের মিশ্রণ। আমি দ্রুত উঠে আমার শ্বশুর কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের রুমে যাই। বাইরে গুলির শব্দে তাঁরও ঘুম ভাঙে। তখন আমি মনি ভাইকে (১৫ আগস্টে নিহত শেখ ফজলুল হক মনি) ফোন করে গুলির শব্দের কথা বলি। ‘

সন্তানহারা এই মা বলতে থাকেন, ইতিমধ্যে আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন আমেনা বেগম) আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে মনি ভাইকে আমাদের বাঁচানোর কথা বলেন। সে সময় আমাদের সঙ্গে বরিশালের একটি গানের দলও ছিল। তারা আমার শ্বশুর আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে জিজ্ঞাসা করে তাদের কী হবে।

আমার শ্বশুর তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার যা হবে তোমাদেরও তাই হবে। ‘ এর মধ্যে আমাদের বাড়ির কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে আর্মিরা। রুমের মধ্যে ঢুকে সবাইকে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাত ওপরে তুলে নেই। তারা সিঁড়ি দিয়ে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে।

শাহনারা বেগম বলেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার শিশু সন্তান সুকান্ত বাবু কাঁদতে কাঁদতে বলছিল- মা, আমাকে কোলে নাও। আমি সুকান্তকে কোলে নিতে পারিনি। পরে শহীদ ভাই (১৫ আগস্টে নিহত শহীদ সেরনিয়াবাত) সুকান্তকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে আসেন।

আর্মিরা জিজ্ঞাসা করছিল ওপরে কেউ আছেন কি না। তখন আমার শ্বশুরের ইশারায় না বলি। কারণ তখন ওপরে আমার স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছিল। আবদুর রব সেরনিয়াবাত আর্মিদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাদের কমান্ডিং অফিসার কে? উত্তরে তারা বলেছিল, কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই; তারা নিজেরাই কমান্ডিং অফিসার। এ কথা বলেই আর্মিরা ব্রাশফায়ার শুরু করে।

স্মৃতিচারণ করে শাহনারা বলতে থাকেন, ওদের ছোড়া গুলি আমার শ্বশুরের বুকে লেগেছিল, শহীদ ভাইও গুলিবিদ্ধ হন। ছেলে সুকান্ত বাবুরও তাদের সঙ্গেই মৃত্যু হয়। আমার পিঠে গুলি লাগে। দশ মাস বয়সী সন্তান সাদিককে (বর্তমানে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ) কোলের মধ্যে নিয়ে জড়িয়ে পড়ে থাকি। গুলি ছুড়ে আর্মি সদস্যরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রমনা থানার ওসি বাসায় আসেন।

ওপর থেকে নেমে আসেন আমার স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ সাহেবও। রমনা থানার ওসি তাঁকে দেখেই প্রশ্ন করেন তিনি কে? উত্তরে হাসানাত সাহেব বলেছিলেন- ‘আমি এই বাড়ির বাবুর্চি। কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসার বাবুর্চি কেঁদে কেঁদে ওসিকে বলেন, ‘স্যার, আমি বাবুর্চি আর স্যারে (আবুল হাসানাত) মন্ত্রী স্যারের বড় ছেলে।

পরিচয় পেয়ে ওসি তাঁকে (হাসানাত) বলেন- স্যার, আপনি দ্রুত চলে যান। ক্যু হয়েছে। আপনাকেও বাঁচতে দিবে না। পরে ওসি ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আহত ও নিহতদের একটি জিপে তুলে নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সন্তানহারা এই মা আরো বলেন, পুলিশের জিপে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানেই ভর্তি করা হয়। জিপ থেকে আমাদের নামানোর কিছুক্ষণ পরই দেখি অন্য একটি জিপ থেকে মনি ভাইয়ের নিথর দেহ নামানো হচ্ছে। আরজু মনিকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শাশুড়ি বলার পর বুঝেছি, আর কেউ বেঁচে নেই। ভেবেছিলাম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করবেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ওরা বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করেছিল।

এর পর আড়াই মাস পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে আমাদের। দীর্ঘদিন দেখা হয়নি স্বামীর সঙ্গেও। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কুকুর-বিড়ালের মতো বেঁচে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন পাকিস্তানিরা চারবার তাঁর জন্য কবর প্রস্তুত করলেও তাঁকে কেউ আঘাত করার সাহস পায়নি। কিন্তু আমাদের দেশের বাঙালিরাই বঙ্গবন্ধুকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করল। এখনো হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এ দেশের মাটিতে। এটাই আমাদের দুঃখ।