padma lifeদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি পদ্মা লাইফের এমডি-চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য বিভিন্ন পোশাক কারখানার ১৫৫ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর তাদের পরিবারকে বীমা দাবি পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায় পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালত ‘ক’ অঞ্চলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বীমা কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), পর্ষদ চেয়ারম্যান ও আরো দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে বিকেএমইএ। ওইদিনই বিবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

এ বিষয়ে পদ্মা লাইফের এমডি চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দীন বলেন, বিবদমান বিষয়টি নিয়ে শ্রম আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। আমি নারায়ণগঞ্জের মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। আমাদের কাছে কোনো সমনও আসেনি। নিষ্পত্তির সপক্ষে শর্তগুলো পূরণ না হওয়ার কারণেই ওই ১৫৫টি বীমা দাবি আটকে আছে বলে জানান তিনি।

আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা লাইফের চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান ও এমডি চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দীন ছাড়া আরো যে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে তারা হলেন, কোম্পানিটির গ্রুপ বীমা বিভাগের সাবেক মহাব্যবস্থাপক লিয়াকত আলী খান ও গ্রুপ বীমা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক নুরুল আলম।

নুরুল আলম বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। দ্বিতীয়ত, যে অভিযোগে আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী হতে পারি না। আমি এখানে সামান্য চাকরি করি মাত্র।

মামলার বাদী বিকেএমইএর যুগ্ম সচিব (ফায়ার অ্যান্ড আরবিট্রেশন) মোহাম্মদ মানিক মিঞা বলেন, মৃত এ শ্রমিকদের বীমা দাবি পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল পদ্মা ইসলামী লাইফ। সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা তাদের গ্রুপ লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসির আওতায় এ অর্থ পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা মামলা করতে বাধ্য হই। চলতি মাসের ৮ তারিখে মামলা করলে আদালত ওইদিনই বিবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

বিকেএমইএ কর্মকর্তারা বলছেন, আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিহত ও অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করা ওই ১৫৫ শ্রমিকের পরিবারকে চুক্তি অনুযায়ী ২ লাখ করে টাকা দেয়ার কথা বীমা প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু শ্রমিকের মৃত্যুর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও পরিবারকে বীমার টাকা পরিশোধ করেনি পদ্মা লাইফ।

তাই দাবি আদায়ে বীমা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতেও ১৫৫ জনের দাবির বিপরীতে ১৫৫টি অভিযোগ করে বিকেএমইএ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কারখানার পক্ষ থেকেও শ্রম আদালতে মামলা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৮ আগস্ট চার্জ গঠনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে।

আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, নানা অনিয়মে ডুবতে বসেছে পদ্মা লাইফ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় ধস নামার পাশাপাশি কমে গেছে লাইফ ফান্ডের আকার। বিনিয়োগ থেকে আয়ও কমে গেছে। ব্যবসার ব্যয়নির্বাহে সীমাতিরিক্ত (আইডিআরএ নির্ধারিত) ব্যবস্থাপনা ব্যয় করছে কোম্পানিটি।

পদ্মা লাইফ ২০১২ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ওই বছর ৮ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিলেও এর পর কখনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। ফলে তালিকাভুক্ত হওয়ার এক বছর পরই জেড ক্যাটাগরিতে চলে যায় কোম্পানিটি।

জানা যায়, নানা অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করায় ২০১৩ সাল থেকে পদ্মা ইসলামী লাইফের ভ্যালুয়েশনের বেসিস অনুমোদন আটকে দেয় আইডিআরএ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বেসিস অনুমোদন দিলেও আর্থিক সংকটের কারণে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি এ কোম্পানি।

এদিকে পদ্মা লাইফের সর্বশেষ অর্থাত্ ২০১৬ সালের ব্যবসা-সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরটিতে প্রথম বর্ষ ও নবায়ন উভয় প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। কমেছে লাইফ ফান্ডের আকার। ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন বা বিনিয়োগ থেকে আয়ও কমে গেছে। আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতেও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে। তামাদি হয়েছে আগের বছর বিক্রি করা প্রায় সিংহভাগ পলিসি।

আইডিআরএ সূত্রে আরো জানা গেছে, পদ্মা লাইফ ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় খাতে অতিরিক্ত ১৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা খরচ করেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে ২৪ কোটি ৬৯ লাখ, ২০১১ সালে ৩৭ কোটি ৩১ লাখ, ২০১২ সালে ৩২ কোটি ৯১ লাখ, ২০১৩ সালে ৩১ কোটি ৫৪ লাখ, ২০১৪ সালে ২৫ কোটি ১১ লাখ, ২০১৫ সালে ৬ কোটি ৭ লাখ এবং ২০১৬ সালে ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বেশি ব্যয় করা হয়।

প্রতি বছর ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করলেও পদ্মা লাইফের বিক্রি করা পলিসির সিংহভাগই পরের বছরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে যে পলিসি বিক্রি করেছিল ২০১৬ সালে এর মাত্র ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ নবায়ন হয়। অর্থাত্ বাকি ৬৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ পলিসি বছর না ঘুরতেই বন্ধ হয়ে গেছে।

জানা যায়, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে মোট ২১ হাজার ৪৪২টি পলিসি তামাদি হয়েছে। ২০১৫ সালে ৫৪ হাজার ৪০০টি, ২০১৪ সালে ৩৫ হাজার ৭৩১টি, ২০১৩ সালে ৫০ হাজার ৭৬টি, ২০১২ সালে ২২ হাজার ৮৬৪টি, ২০১১ সালে ৯৭ হাজার ৪৮৮টি এবং ২০১০ সালে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৬টি পলিসি তামাদি হয়।