samata ladar

দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চামড়া খাতের লোকসানি কোম্পানি সমতা লেদারের শেয়ারদর কোনো কারণ ছাড়াই টানা বাড়ছে। ফলে এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। আর এ কারসাজির সঙ্গে খোদ কোম্পানির পরিচালকরা জড়িত বলে একাধিক বিনিয়োগকারীর অভিযোগ।

সম্প্রতি বাজারে নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সমতা লেদারের। লোকসানী কোম্পানি নাকি ডিভিডেন্ড দিবে এরকম নানামুখী গুজবে শেয়ারদর টানা বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন টানা দরবৃদ্ধির পরও কোম্পানিটির উপর কোনো নজরধারী নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানির শেয়ার নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সার্ভিল্যান্স বিভাগ পুঁজিবাজারের অনিয়মরোধে তেমন কোনো কাজেই আসছে না। দাতা সংস্থা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ ও অত্যাধুনিক সফটওয়্যার সংযোজনের পরও বাজার তদারকিতে কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারছে না বিএসইসির এই বিভাগ।

সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক স্বল্পমূলধনী ও লোকসানি শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বিএসইসি। এতে করে বাজারের অনিয়মরোধে বিএসইসির এ বিভাগের ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার স্থাপন করে বিএসইসি। পুঁজিবাজারে নজরদারি আরো জোরদার করতে দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় এ সফটওয়্যার চালু করা হয়।

ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ১ এর আওতায় নতুন সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার স্থাপনের অর্থ খরচ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাধিকবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বাড়ানো কিংবা নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এদিকে মাসের পর মাস স্বল্পমূলধনী ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকহারে বাড়ার পরও কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসিকে তেমন কিছুই করতে দেখা যায়নি। এ নিয়েও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভের কমতি নেই। এ সময় তারা প্রকৌশল খাতের লোকসানি কোম্পানির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির পরও বিএসইসির নিরব ভ‚মিকার সমালোচনা করেন।

তারা মনে করছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি অনিয়ম রোধের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্তের নামে বিনিয়োগকারীদের আশার বাণী শোনাচ্ছে। চামড়া খাতের কোম্পানি সমতা লেদোরের অস্বাভাবিক হারে শেয়ারদর বাড়ার পেছনে অপ্রকাশিত কোনো প্রকার কারণ নেই বলে জানিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, সমতা লেদারের কাছে সাম্প্রতিক দর বাড়ার পেছনে কারণ জানতে চেয়ে সম্প্রতি ডিএসই গত ২৪ জুলাই নোটিশ পাঠায়। এর জবাবে কোম্পানিটি ২৫ জুলাই জানায়, কোনো রকম অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ারদর বাড়ছে। তবে এরপর টানা বাড়লেও কোম্পানিটিকে ডিএসইর পক্ষ থেকে আর কোনো শোকজ করা হয়নি।

samata ladar 1 monthবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত একমাস ধরে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েই চলেছে। গত ২৩ জুলাই থেকে এ শেয়ারের দর ছিলো ৩৩ টাকা। আর ২১ আগস্ট এ শেয়ারের লেনদেন হয়েছে ৫৯.৮০ টাকায়। তবে দিনভর শেয়ারটি ৫৮.৭০ টাকা থেকে ৬১.১০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে। গত একমাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২৬.৮০ টাকা প্রায় ৭৮ শতাংশ।গত এক বছরে এ শেয়ারটি ২৩.৫০ টাকা থেকে ৬১. ১০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে।

samata ladar 1 yearএ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে এক প্রকার জুয়া খেলা চলছে। তবে এবার ছোট বাজারে ছোট আকারে হচ্ছে। যে সব কোম্পানির দর বাড়ার কথা, সে সব কোম্পানির দর না বেড়ে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির দর বেড়েই চলছে। কয়েক দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই যে সব কোম্পানি সার্কিট ব্রেকারে পৌঁছেছে, সেগুলোকে নিয়ে বাজারে বিভিন্ন গুজব রয়েছে বলে জানান তিনি। আর কিছু কিছু বিনিয়োগকারী গুজব শুনে ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তবে প্রশ্ন হলো কি কারনে দর বাড়ছে সমতা লেদারের এর কারন খুঁজতে এর আগেও দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানী টিম প্রতিবেদন তৈরি করে। সমতা লেদার কোম্পানিটি মাত্র এক মাসের প্রায় দ্বিগুনের মত দাম বাড়ছে। এত অল্প সময়ে লাফিয়ে লাফিয়ে শেয়ারটির দরবৃদ্ধির পেছনে মালিকপক্ষের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানেও কোম্পানির পরিচালকরা ও কর্মকর্তরা জড়িত বলে সুত্রে জানায়। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ দাবী দরবৃদ্ধির নেপথ্যে বাজারে কারসাজিকারকরাই জড়িত বলে মনে করেন তারা।

গতকাল ডিএসই মতিঝিল ভবনে একাধিক সিকিউরিটিজ হাউস ঘুরে বিনিয়োগকারীদের বলতে শোনা যায়, সমতা লেদারের শেয়ারের দর আরো বাড়বে। তবে কি কারনে বাড়বে তারা বলতে পারছেন না। তারাও গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনছেন। তবে কোম্পানিটির শেয়ারের দরবৃদ্ধির গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ পোশন করছেন বিনিয়োগকারীরা। কেউ বলতে পারছেন না যে এই শেয়ারের দরবৃদ্ধির পেছনে কোনো মুল্য সংবেদনশীল তথ্য রয়েছে কিনা।

এদিকে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের (জুলাই থেকে মার্চ) নয় মাসের এই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৭ পয়সা। যা আগের বছর একই সময় ছিল ৪ পয়সা। অর্থাৎ আলোচ্য সময় শেয়ারপ্রতি ৩ পয়সা করে লোকসান বেড়েছে কোম্পানিটির। অথচ এ লোকসানী কোম্পানির শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

বর্তমানে এ শেয়ারটি লেনদেন হচ্ছে গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরে। যদিও এর পিই রেশিও ঋণাত্বক। আর পিই রেশিও বিবেচনায় শেয়ারে এখন বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মূল্য আয়ের অনুপাত বা পিই রেশিও ১৫ থেকে ২০ পর্যন্ত অনেকটা নিরাপদ। পিই রেশিও এর উপরে যত উঠবে ঝুঁকি ততই বাড়বে। এক্ষেত্রে সমতা লেদারের পিই রেশিও ঋণাত্বক। অন্যদিকে ৪০ পর্যন্ত পিই রেশিও নিরাপদ মনে করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর উপরের পিইধারী কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য মার্জিন ঋণ প্রদানে সংস্থাটির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তাই নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি বাছাই করার ক্ষেত্রে পিই রেশিও হলো সর্বোচ্চ মাপকাঠি। এছাড়াও কোম্পানির মুনাফা, শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের পরিমাণ বা এনএভিপিএস, নগদ কার্যকরি নীট প্রবাহ বা এনওসিএফপিএস, ডিভিডেন্ডের হার ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সমতা লেদারের অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫০ শতাংশ রয়েছে পরিচালকের হাতে। বাকী শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ রয়েছে।