BBS20170520151940দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে অর্থ উত্তোলন করা বিবিএস ক্যাবলস এবার শেয়ারের দাম ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে কোম্পানিটির শেয়ার দাম। অনৈতিকভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানোর পেছনে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ও বিবিএস ক্যাবলস’র মালিকপক্ষ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ায় গত মঙ্গলবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ বিষয়ে বিএসইসি’র দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাত্র ১৫ কার্যদিবসেই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় দেড়শ টাকা হয়েছে। এ অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে গত ১৮ আগস্ট বিবিএস ক্যাবলস (ইউনিট-২) লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠন নিয়ে জার্মানি, ইতালি, চীন ও ভারতের মেশিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি বড় ভূমিকা রেখেছে।

পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন শুরু হওয়ার দিনই (৩১ জুলাই) বাজারে গুঞ্জন ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, বিবিএস ক্যাবলস জার্মানি, ইতালি, চীন ও ভারতের বিখ্যাত বিভিন্ন মেশিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। এমন গুঞ্জনে হু হু করে বাড়তে থাকে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম।

ফলে লেনদেন শুরুর মাত্র ছয় কার্যদিবস পরই ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির কাছে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ পাঠায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। জবাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের কাছে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

এর পাঁচ কার্যদিবস পরই ঢাকায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতে এক জমজমাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবিএস ক্যাবলস (ইউনিট-২) লিমিটেড জার্মানি, ইতালি, চীন ও ভারতের বিভিন্ন মেশিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এ চুক্তির পর মাত্র দুই কার্যদিবসে বিবিএস ক্যাবলস’র শেয়ারের দাম বেড়ে ১৪৯ টাকা ৭০ পয়সায় পৌঁছে যায়।

বিবিএস ক্যাবলস (ইউনিট ২) লিমিটেড’র করা চুক্তি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিবিএস ক্যাবলস’র শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হলেও কোম্পানি দুটি সম্পূর্ণই পৃথক। বিবিএস ক্যাবলস’র (ইউনিট-২) একটি শেয়ারও বিবিএস ক্যাবলস’র মালিকানায় নেই বলে আমাদের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) আমিনুল ইসলাম।

জানা গেছে, বিবিএস ক্যাবলস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু নোমান হাওলাদারের পিতা আবদুল হান্নান হাওলাদার উচ্চ মূল্যে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। আবদুল হান্নান কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার। তার কাছে রয়েছে মোট শেয়ারের দুই শতাংশ বা ২০ লাখ শেয়ার।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্তির পর দ্বিতীয় দিনে গত ১ আগস্ট আবদুল হান্নান হাওলাদার ৮৮ টাকা দরে ৬০ হাজার শেয়ার ৫৩ লাখ টাকায় কেনেন। এরপর ৮ আগস্ট ১০৭ টাকা দরে ১০ হাজার শেয়ার কেনেন। ওই দিনই তিনি ১০৬ টাকা দরে ১০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন। পরের দিন আবদুল হান্নান ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন ১১১ টাকা দরে। এরপর ১৬ আগস্ট ১২০ টাকা দরে ৩৫ হাজার শেয়ার কেনেন এবং ২০ আগস্ট ওই ৩৫ হাজার শেয়ার ১৩৩ টাকা দরে বিক্রি করেন। এভাবে শেয়ার কেনাবেচা করে তিনি প্রায় ২৮ লাখ টাকা মুনাফা করেছেন।

এদিকে, আবদুল হান্নানের ছেলে আবু নোমান হাওলাদার বিবিএস ক্যাবলসের এমডি পদে অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমসসহ চারটি কোম্পানিতে এমডি হিসেবে থাকা সত্তে¡ও বিবিএস ক্যাবলসে একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারায় বলা আছে, এই আইন প্রবর্তনের পর কোনো পাবলিক বা তার অধীনস্থ কোম্পানি এমন কোনো ব্যক্তিকে এমডি হিসাবে নিয়োগ দেবে না, যিনি অন্ততপক্ষে অপর একটি কোম্পানিতে একই পদে আছেন।

পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমসের পরিচালকদের মধ্যে মোহাম্মদ বদরুল হাসান, আবু নোমান হাওলাদার, হাসান মোর্শেদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রুহুল মাজিদ ও আশরাফ আলি খান বিবিএস ক্যাবলস’র পর্ষদেও রয়েছেন।
বিবিএস ক্যাবলস’র শেয়ারের দাম বাড়াতে আবদুল হান্নান হাওলাদারের মতো কয়েকজন প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী জড়িত রয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকও এ অনৈতিক কাজে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে বিবিএস ক্যাবলস যে প্রসপেক্টাস বিএসইসিতে জমা দেয় তার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রসপেক্টাসের ৫৯ পৃষ্ঠায় বিগত পাঁচ বছরের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইনকাম স্টেটমেন্টে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) গণনায় বিএএস-৩৩ অনুযায়ী, শেয়ার ওয়েটেড করে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ইপিএস হিসাব করা হয়েছে।

কিন্তু ২০১২ সালে ওয়েটেড না করে হিসাব মান লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফলে ভুল ইপিএস দেখানো হয়েছে। এ বছর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২৯ টাকা ১৬ পয়সার পরিবর্তে ১৪ টাকা ৩৫ পয়সা ইপিএস দেখিয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে ভুলভাবে ২৪ টাকা ৩৩ পয়সা ইপিএস ২৬ টাকা ১৭ পয়সা দেখিয়েছে।

২০১২ সালে কোম্পানিটি সাত কোটি ১৮ লাখ টাকা মুনাফা করেছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে চার কোটি ২২ লাখ টাকার মুনাফা বেশি দেখানো হয়েছে। এ বছর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ডেফার্ড ট্যাক্স গণনা না করে এ মুনাফা বেশি দেখায়। নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) হিসাবেও মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস ক্যাবলস।

হিসাব মান অনুযায়ী, প্রতি বছর ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হিসাব করা হলেও ২০১২ সালে করা হয়নি। ফলে এ বছর এনওসিএফপিএস ঋণাত্মক ২০৬ টাকা ৬৯ পয়সা হলেও কমিয়ে ১০১ টাকা ৮০ পয়সা দেখানো হয়।

বিএএস ১ অনুযায়ী, তুলনা করার জন্য চলতি বছরের পাশাপাশি আগের বছরের একই সময়ের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু বিবিএস ক্যাবলস কর্তৃপক্ষ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের ‘স্টেটমেন্ট অব চেঞ্জেস ইন ইক্যুইটি’ হিসাবের তথ্য প্রকাশ করলেও আগের বছরে করা হয়নি। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলনের তিন মাসের মধ্যে ২০ কোটি টাকা ব্যবহার করা হবে বলে প্রসপেক্টাসের ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে একই বিষয়ে ১৪৬ পৃষ্ঠায় আবার ছয় মাস ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

প্রাচীর, ফ্যাক্টরির ভেতরে রাস্তা, পার্কিং প্লেস, বাগান ইত্যাদি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। এসব সম্পত্তির নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে। বিএএস-১৬ অনুযায়ী, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অবচয়যোগ্য সম্পদ। কিন্তু বিবিএস ক্যাবলস এ সম্পদের ওপর অবচয় চার্জ করেনি। এর মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখিয়েছে। হিসাব মান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডাইলুটেড ইপিএস গণনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখানে কোনো কিছুই কমন শেয়ারে রূপান্তর হয় না। এক্ষেত্রে বিবিএস ক্যাবলসও এর বাইরে নয়। বিষয়টি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ প্রসপেক্টাসের ১৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।

তবে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবার ডাইলুটেড ইপিএস হিসাবে যথাক্রমে ২ টাকা ৪৬ পয়সা ও ২ টাকা ১ পয়সা দেখিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমন শেয়ারে কোনো পরিবর্তন না আসায় ওয়েটেড করা লাগেনি বলে প্রসপেক্টাসের ১৬৯ পৃষ্ঠায় তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এ বছর ৯০ কোটি টাকার শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে বলে ১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বছর শেয়ার ওয়েটেড করেও ইপিএস দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে।

ভবিষ্যতে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য হিসাবমানে দেনাদারের বিপরীতে সঞ্চিতি গঠনের নিয়ম রয়েছে। তবে বিবিএস ক্যাবলস’র আনসিকিউরড বা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই এমন ৯৪ কোটি ১০ লাখ টাকা অন্যের কাছে পাওনা থাকলেও সঞ্চিতি গঠন করা হয়নি। ফলে কখনও এই টাকা আদায় না হলে, তার দায়ভার এসে পড়বে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে।

প্রসপেক্টাসের ৬০ পৃষ্ঠা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নিট পরিচালন নগদ প্রবাহ হয়েছে ৮১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে এ বছর শেয়ারপ্রতি নিট পরিচালন নগদ প্রবাহ হয়েছে ১ টাকা ৬৪ পয়সা। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিট পরিচালন নগদ প্রবাহ তিন কোটি ৯৩ লাখ টাকা হিসাবে নিয়ে শেয়ারপ্রতি সাত টাকা ৮৭ পয়সা দেখিয়েছে।

কোম্পানিটির শেষ তিন বছরের মধ্যে সক্ষমতার ৬১ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৫ শতাংশ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬ শতাংশ ছিল। এ হিসাবে বিগত তিন বছরে সক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন উত্থান-পতনে ছিল। তবে এ উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়বে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭০ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭২ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৫ শতাংশ হবে। শ্রমিকদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে বিবিএস ক্যাবলস। একই সঙ্গে শ্রমিক আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। কোম্পানিটি ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী ২০১২ ও ২০১৩ সালে নিট আয়ের ৫ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন এবং বিতরণ কোনোটাই করেনি। ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর পরের তিন বছর ফান্ড গঠন করা হলেও আইন অনুযায়ী বিতরণ করা হয়নি।

যোগাযোগ করা হলে বিবিএস ক্যাবলস’র প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, শেয়ারের দাম বাড়ার পেছনে কোম্পানির কেউ জড়িত নেই। যদি এমডির পিতা থাকেন, সেটি তার বিষয়। তিনি কোম্পানির কেউ নন। আর বিবিএস ক্যাবলস (ইউনিট ২) আলাদা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে প্রসপেক্টাসে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।