RSRMদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (আরিএসআরএম) উদ্যেক্তা পরিচালকরা সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করে গত এক বছরে ১ কোটি ১৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন। চড়া দরে এসব শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে প্রায় একশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, উদ্যেক্তারা তাদের শেয়ার চড়া দামে বিক্রি করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোম্পানির আয় ২৯৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। কোম্পানির আয় হঠাৎ তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির শেয়ার দরেও আচমকা ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। এ সময়ে কোম্পানির শেয়ার দর কিছুদিনের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ সুযোগে উদ্যেক্তারা চড়া দামে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেন।

rsrm-finalতথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন ২০১৬ তারিখে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ছিল ৪৭.১৪ শতাংশ। আর একবছর পর ৩১ জুন ২০১৭ তারিখে তাদের শেয়ার কমে দাঁড়ায় ৩৩.৩৮ শতাংশে। একবছরের ব্যবধানে উদ্যেক্তা পরিচালকরা কোম্পানিটির ১৩.৭৬ শতাংশ বা ১ কোটি ১৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন।

তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির আগে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দেয়ার বিধান থাকলেও আরএসএমের উদ্যোক্তারা ১ কোটি ১০ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৯০ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। অবশিষ্ট ২৯ লাখ শেয়ার ঘোষণা ছাড়াই বিক্রি করে দিয়েছেন।

এদিকে, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টম্বর ২০১৬) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ১.২২ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর ইপিএস ছিল ১.২৬ টাকা। অর্খাৎ প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির আয় কম হয়েছে।

আর দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬) কোম্পানিটির আয়ে হঠাৎ উল্লম্ফন দেখা দেয়। এ সময়ে ইপিএস আসে ২.০২ টাকা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ০.৫১ টাকা। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রান্তিক কোম্পানিটির আয় বৃদ্ধি পায় ২৯৬ শতাংশ। আবার তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারী-মার্চ ২০১৭) ইপিএস দেখানো হয় ২.৯০ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর ইপিএস ছিল ০.৮৪ টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকে আয়ে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ২৪৫ শতাংশ। আয়ে উল্লম্ফনের কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দরেও বড় উল্লম্ফন দেখা দেয়।

অন্যদিকে, আগের বছর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩.৪৫ টাকা। সেই বছর কোম্পানিটি লভ্যাংশ দিয়েছে ২০ শতাংশ। এরমধ্যে ১০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ স্টক। সমাপ্ত বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় এসেছে ৮.১৮ টাকা। আর এবছর লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে ২২ শতাংশ।

এরমধ্যে ১৭ শতাংশ স্টক ও ৫ শতাংশ ক্যাশ। এছাড়া, ১৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩:২ হারে রাইট শেয়ার ইস্যু করার ঘোষণা দিয়েছে। সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি হয়েছে ৮.১৮ টাকা এবং লভ্যাংশ দিয়েছে ২.২০ টাকা। অর্খাৎ গতবছর কোম্পানিটি আয়ের ৬৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর এবছর আয়ের মাত্র ২৬.৯০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সত্যি সত্যি যদি কোম্পানির আয় বেড়ে থাকে, তাহলে লভ্যাংশ এতো কম দিলো কেন? তাদের অভিযোগ, এবছর লভ্যাংশ এতোটাও হতো না, যদি কোম্পানি রাইট শেয়ার ছাড়ার উদ্দেশ্য না থাকতো। রাইট শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তুলতে হবে কেবল এ কারণেই ২২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। তা না হলে এবছর আরও কম লভ্যাংশ ঘোষণা করতো। তারা প্রশ্ন তুলছেন, এবছর কোম্পানিটি গতবছরের তুলনায় আয় বৃদ্ধি দেখিয়েছে ১৬০ শতাংশ, আর লভ্যাংশ বাড়িয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ।

বাজার সংশ্লিষ্টরা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, শাইনপুকুর সিকামিক, সামিট পাওয়ার, আফতাব অটোমোবাইলের মতো কোম্পানিগুলো যেবছর রাইট শেয়ার ছাড়ে, সে বছর কোম্পানিগুলোর আয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা গেছে। কিন্তু রাইট শেয়ার ছাড়ার পরের বছর হতে কোম্পানিগুলোর আয়ে ভাটা দেখা দেয়। কোম্পানিগুলোর আয়ে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রবণতা তৈরী হয়। আরএসআরএমও ওইসব কোম্পানির পথে হাঁটছে বলে তাঁদের আশঙ্কা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দ্বিতীয় প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬) থেকে কোম্পানিটি হঠাৎ জলসে উঠে। এ সময়ে কোম্পানির আয় হঠাৎ করে ২৯৬ শতাংশ বেড়ে যায়। আয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা দেয়ায় শেয়ারদরেও আচমকা উল্লম্ফন দেখা দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানিটির শেয়ারদর ৪২ টাকা থেকে ৮০ টাকার উপরে উঠে যায়।

আর এ সুযোগে উদ্যোক্তারা তাদের শেয়ার ছাড়তে শুরু করেন। দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর উদ্যেক্তা পরিচালক মাকসুদুর রহমান ও শামসুন্নাহার রহমান স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রত্যেকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দেন, যা পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ওই ৩০ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫১.৪০ টাকা হতে ৮৪.৫০ টাকা পর্যন্ত।

এর দু’দিন পর অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর মাকসুদুর রহমান ও শামসুন্নাহার রহমান প্রত্যেকে আরও ৫ লাখ করে ১০ লাখ শেয়ার পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিক্রি করার ঘোষণা দেন। ওই ৩০ কার্যদিবসে শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর ছিল ৫৮.৬০ টাকা হতে ৮৭.৭০ টাকা। একই মাসে অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর মাকসুদুর রহমান আরও ২০ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ওই ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৭১.৮০ টাকা হতে ৮৮.২০ টাকা।

এরপর ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারী মাকসুদুর রহমান ১৩ লাখ শেয়ার এবং শামসুন্নাহার রহমান ৭ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ওই ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ৭৬.৭০ টাকা এবং সর্বোচ্চ দর ছিল ৮৩.৭০ টাকা।

২০১৭ সালের ৯ মার্চ ইউনুছ ভূইয়া ১৩ লাখ শেয়ার এবং শামসুন্নাহার রহমান ৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ঘোষণা দেয়ার পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ৮৪.৪০ টাকা এবং সর্বোচ্চ দর ছিল ৯৩.৪০ টাকা। সর্বশেষ, ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল মিজানুর রহমান ও মারজানুর রহমান প্রত্যেকে এক লাখ করে দুই লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ওই ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শেয়ারটির দর ছিল ৮৩.১০ টাকা হতে ৮১.৭০ টাকা।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আরএসআরএমের উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা দিয়ে ৯০ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন। আর ঘোষণা ছাড়া আরও ২৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৯ লাখ শেয়ার বাজারে বিক্রি করেছেন, যার মূল্য হবে প্রায় একশত কোটি টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির উদ্যেক্তারা একদিকে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করে অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করেছেন। অন্যদিকে, চড়া দরে শেয়ার বিক্রি করার উদ্দেশ্যে কোম্পানির আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছেন। কেননা ক্ম্পোানির আয় যদি বাস্তবিকই হতো, তাহলে লভ্যাংশ আরও অনেক বেশি হতো। দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিষয় দুটির উপর তদন্ত পরিচালনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় তালিকাভুক্ত অন্যান্য কোম্পানিও এরকম অনৈতিক পথে বিচরণ করার সুযোগ গ্রহণ করবে।