companyদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৮ কোম্পানির অস্তিত্ব নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। বছর শেষে প্রতিটি কোম্পানির কাছ থেকে ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ আশা করেন বিনিয়োগকারীরা। অথচ তালিকাভুক্ত পর থেকে এসব কোম্পানি নানা ধরনের সমস্যা দেখিয়ে টানা বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত করে আসছে বিনিয়োগকারীদের। অথচ ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করলেও কোন কারন ছাড়াই টানা বাড়ছে এসব শেয়ারের দর। ফলে এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে দু:চিন্তায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাও।

টানা লোকসানে ঋণ ও দায়ের পরিমাণ সম্পদের তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় দেউলিয়ার পথে রয়েছে কিছু কিছু কোম্পানি। এতে বিনিয়োগ হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিগুলো হলো: আজিজ পাইপস, দুলামিয়া কটন, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, মেঘনা পেট, শ্যামপুর সুগার এবং ঝিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেড, ইমাম বাটন, জুট স্পিনার্স , সমতা লেদার।

এ কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে নিরীক্ষকদের মতামত থেকে জানা যায়, উৎপাদন ক্ষমতা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় ব্যবসা হারাচ্ছে কোম্পানিগুলো। অপরদিকে টানা লোকসানে কোম্পানিগুলোর সমন্বিত লোকসান লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এর পাশাপাশি ঋণ ও দায়ের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে কোম্পানিগুলোর সম্পদমূল্যকেও ছাড়িয়েছে।

পরিণতিতে এ কোম্পানিগুলো দায় পরিশোধের ক্ষমতা হারিয়ে বর্তমানে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। আর এ কোম্পানিগুলো মুনাফায় না আসতে পারলে ভবিষ্যতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইন অনুযায়ী টানা লোকসান, উৎপাদন বন্ধ, অনিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ইত্যাদি সমস্যা সংকুল কোম্পানিগুলোকে মূল মার্কেট থেকে সরিয়ে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে পাঠানোর ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে।

এ ছাড়া যেসব কোম্পানি লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিন ধরে ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না সেসব কোম্পানির পর্ষদে প্রশাসক বা পর্যবেক্ষক বসানোর ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসইসর মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, কমিশনে জনবলের ঘাটতি থাকায় আর্থিক ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বল কোম্পানিগুলোতে প্রশাসক কিংবা পর্যবেক্ষক বসানো যাচ্ছে না। তবে কোম্পানিগুলোকে ওটিসেতে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এসব দুর্বল কোম্পানির মধ্যে বেশকিছু সরকারি কোম্পানি থাকায় ওটিসিতে পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। তবে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় এ বিষয়ে কমিশন কাজ করছে।

এদিকে ডিএসইতে দেখা যায়, লোকসানি হওয়া সত্তেও এ সকল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি চক্র থেমে নেই। দেখা যায় প্রায় কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে। এই ১০ কোম্পানির শেয়ারের দর ১ বছরের তুলনায় কয়েকগুন বাড়ছে। এর মধ্যে আজিজ পাইপস বাড়ছে আড়াই গুন। এ বিষয়ে ডিএসইর পক্ষ থেকে দর বাড়ার কারন জানতে চাওয়া হলে জবাবে কোম্পানিগুলো খুব সহজ উত্তর দিয়ে থাকে “দর বাড়ার পেছনে কোন মুল্য সংবেদনশীল নেই”।

আজিজ পাইপস : ১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া প্রকৌশল খাতের আজিজ পাইপসের অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অথচ এ কোম্পানিটির দায়ের পরিমাণ ৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিশোধিত মুলধনের ১৫ গুণ দায় বহন করছে কোম্পানিটি।

দুলামিয়া কটন : বস্ত্র খাতের ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি দুলামিয়া কটনের অনুমোদিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ কোম্পানির নিরীক্ষকের মতে, কোম্পানিটি দায় পরিশোধের ক্ষমতা হারাচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি দেউলিয়ার দিকে যাচ্ছে।

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক : ব্যাংক খাতের ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ১ হাজার ৬৬৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

এর মোট ৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ২ হাজার ৩০০টি শেয়ারের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের কাছে রয়েছে ৫৯.৭৮ শতাংশ, সরকারের কাছে ০ দশমিক ১৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ১৫.৬৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ২৪.৩৭ শতাংশ শেয়ার। বর্তমানে এটি একটি লোকসানি কোম্পানি যার অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে।

মেঘনা পেট : ২০০১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি মেঘনা পেটের অনুমোদিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১২ কোটি টাকা। কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অডিটরের মতে, আর এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কোম্পানিটি দেউলিয়ায় পরিণত হবে।

শ্যামপুর সুগার : খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি খাতের ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি শ্যামপুর সুগার অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫ কোটি টাকা। অডিটরের মতে, প্রতি বছর কোম্পানিটির দায়, ঋণ ও সুদের পরিমাণ বাড়ছে। কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ২৯৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির মোট ৫০ লাখ শেয়ারের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ রয়েছে ৫১ শতাংশ, এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৪১.৭৯ শতাংশ শেয়ার।

ঝিলবাংলা : খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ঝিলবাংলার অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৬ কোটি টাকা। এর পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ২৩৭ কোটি ২ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট ৬০ লাখ শেয়ারের মধ্যে সরকারের কাছে রয়েছে ৫১ শতাংশ, পরিচালকদের কাছে ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কছে রয়েছে ০.০৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৪৭.১০ শতাংশ শেয়ার।

ইমাম বাটন: ইমাম বাটনের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইমাম বাটন সম্পর্কে বলা হয়, চলমান সংকট কাটাতে না পারলে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির কার্যক্রম ভবিষ্যতে ধাক্কা খেতে পারে। সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে কোম্পানিটি সম্পর্কে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানির এ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রামভিত্তিক বোতাম উৎপাদনকারী এ কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১১ সাল থেকে কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি। এ কারণে নিয়ম অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটিকে দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করেছে।

সাত কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ৭৭ লাখ। যার মধ্যে প্রায় ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ শেয়ারই রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩১ শতাংশ ৫৩ শতাংশ শেয়ার।

জুট স্পিনার্স: জুট স্পিনার্সের কোম্পানির ভবিষ্যত কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে এর নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে যাওয়ায় এ মতামত দিয়েছে নিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি। কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

এত বড় লোকসান নিয়ে ভবিষ্যতে কোম্পানিটির এগিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৮৪ সালে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৩ কোটি ৫০ লাখ ও পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ রয়েছে ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

সমতা লেদার: অন্যদিকে পুঞ্জিভুত লোকসান না থাকলে ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করেছে সমতা লেদার। চামড়া খাতের এ কোম্পানিটি ‘জেড’ ক্যাটাগরি অবস্থান করেছে। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট ১ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার শেয়ারের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের কাছে রয়েছে ৫০.০০ শতাংশ, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কছে রয়েছে ১৭.৭৯ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৩২.২১ শতাংশ শেয়ার।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জবাবদিহিতার অভাবে কোম্পানিগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। একে ‘দিনে দুপুরে ডাকাতি’ বলেও অভিহিত করেছেন তারা। যে সব কোম্পানি নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয় না এবং যেগুলোর উৎপাদন বন্ধ, সেগুলো ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করে।

নিয়মানুযায়ী সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে না পারলে ওই কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয় ওইসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা মার্জিন ঋণ থেকেও বঞ্চিত হয়। এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে যেগুলো আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরের বছর থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে।

সঠিকভাবে খোঁজখবর না নিয়ে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করার অনুমোদন দেয়ার কারণে এসব দুর্বল কোম্পানির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেছেন, কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। এমন কোনো আইনও নেই যেখানে কোনো কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থাকলে ফাইন হবে। অর্থাৎ কথিত আইনের মাধ্যমে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে দিনে দুপুরে মানুষের টাকাগুলো ডাকাতি করা হচ্ছে।