foraginআসিফুজ্জামান পৃথিল, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কোম্পানির সচ্ছলতা, শক্তিশালী রিজার্ভ, উচ্চ লভ্যাংশ প্রদান সহ নানাবিধ কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রতি সবসময়েই আলাদা আগ্রহ থাকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ সত্বেও শেয়ার ছাড়ছে না। এর ফলে আগ্রহ থাকার পরেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানির শেয়ার ক্রয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যমতে, মাত্র ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। অথচ চার শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে।  এর মধ্যে ১৩টি কোম্পানি হলো: ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, বার্জার পেইন্টস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, রেকিড বেনক্লিজার (বাংলাদেশ) লিমিটেড, গ্লাক্সোস্মিথকাইন (বাংলাদেশ) লিমিটেড, লিন্ডে (বাংলাদেশ) লিমিটেড, বাটা সু, ম্যারিকো (বাংলাদেশ) লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, গ্রামীণফোন, সিঙ্গার (বাংলাদেশ) লিমিটেড, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, ফু-ওয়াং সিরামিকস এবং ফু-ওয়াং ফুডস। এই ১৩টি কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশেরই পাবলিক শেয়ারের সংখ্যা নামে মাত্র। ফু-ওয়াং সিরামিকস এবং ফু-ওয়াং ফুডস ব্যতিত বাকি ১১টি কোম্পানির প্রত্যেকটির শেয়ারের পরিমান ২০ শতাংশেরও কম।

ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, বার্জার পেইন্টস এবং গ্লাক্সোস্মিথকাইনের শেয়ারের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে ১ শতাংশেরও কম! যেহেতু এসকল কোম্পানি ভালো ডিভিডেন্ড দিতে সক্ষম তাই এসকল কোম্পানির শেয়ারের পরিমাণ এত কম থাকা মানে বিনিয়োগকারীদের এক রকমের বঞ্চিত করা বলে মনে করেন বাজার সংশিষ্টরা।  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির কারণে এসব কোম্পানি ১০ শতাংশ কর অবকাশ সুবিধা পায়। বিনিয়োগকারীদেরও এসব কোম্পানির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। বর্তমানে এসব কোম্পানির বাজার মূলধন ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

শুধু তাই নয় সরকারের নানান চেষ্টার পরেও বাজারে আসতে কোন প্রকার আগ্রহ দেখাচ্ছে না অন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।  গত ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর বহুজাতিক কোম্পানিকে কিভাবে বাজারে তালিকাভুক্ত করা যায়, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পরে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি আরও একদফা অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তারপরও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় আবারও সুস্পষ্ট সুপারিশসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১৩ মে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা পরিচালনাকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে।

সেগুলোকে এখন পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তির সময় এসেছে। মুহিত বলেন, একটা সময় পুঁজিবাজার ফাটকা বাজারই ছিল। কোনো আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি ছিল না। এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন আর ফাটকা বাজার নয়; এর ফলাফল আমরা দেখছি। বাজার অনেকটা স্থিতিশীল।

এ পরিস্থিতিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বলতে পারি, তোমরা পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়। বহুজাতিক অনেক কোম্পানি এ দেশে এসে একচেটিয়া ব্যবসা করছে, কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। অন্য দেশে এসব কোম্পানি ঠিকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে তালিকাভুক্তির নজির রয়েছে। ২০০৯ সালে গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর দেশের পুঁজিবাজারে এ ধরনের আর কোনো বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি।

সম্প্রতি সরকার পুঁজিবাজারে বিদেশি কোম্পানি তালিকাভুক্তির বিষয়ে তৎপর হয়েছে। গত মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে আšন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছে মতামত চাওয়া হয়। সেখানে বিদেশি কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে সমস্যা ও করণীয় ঠিক করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মতামত দিয়েছে। আইসিবির পাঠানো সার সংক্ষেপে বলা হয়েছে, দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াগত জটিলতায় তাদের শেয়ার বাজারে আসছে না।

সেখানে আরও বলা হয়েছে, টেকসই ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনে এ ধরনের মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার বাজারে আনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। দেশি কোম্পানির চেয়ে বিদেশি কোম্পানিতে শেয়ার বিনিয়োগে ঝুঁকি কম। বিদেশি কোম্পানিগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো জবাবদিহিতার মধ্যে থাকার কারণে পর্যাপ্ত মুনাফা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেশি। লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষমতাও এসব কোম্পানির বেশি। এ জন্য দেশি কোম্পানির মতো বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আসা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ আইসিবির। এ ছাড়া তালিকাভুক্তির জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান জানান, এ কোম্পনিগুলোকে পর্যায়ক্রমে পুঁজিবাজারে আনতে অর্থ-মন্ত্রণালয় ও কোম্পানির সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছি। এখনো কাজ করছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এরা পুঁজিবাজারে আসতে চায় না।

ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ০.৬৩ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৬ কোটি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৩ লাখ ৭৮ হাজারটি শেয়ার রয়েছে।

বার্জার পেইন্টস : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ০.৪৯ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ২ কোটি ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৯৪০টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ১ লাখ ১৩ হাজার ৬২৬টি শেয়ার রয়েছে।

রেকিড বেনক্লিজার : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ৪.৮৪ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৪৭ লাখ ২৫ হাজারটি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ২ লাখ ২৮ হাজার ৬৯০টি শেয়ার রয়েছে।

গ্লাক্সোস্মিথকাইন : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ০.৯৫ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১ কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৯টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৪১টি শেয়ার রয়েছে।

লিন্ডে বিডি : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১১ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ ১৮ হাজার ২৮০টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ১১টি শেয়ার রয়েছে।

বাটা সু : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১০.৪৬ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজারটি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯২৮টি শেয়ার রয়েছে।

ম্যারিকো বাংলাদেশ : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১.০৬ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৩ কোটি ১৫ লাখটি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯০০টি শেয়ার রয়েছে।

হাইডেলবার্গ সিমেন্ট : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১১.৫০ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩ হাজার ৫৮০টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৫৪টি শেয়ার রয়েছে।

গ্রামীণফোন : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১.৯৪ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১৩৫ কোটি ৩ লাখ ২২টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ২ কোটি ৬১ লাখ ৯৫ হাজার ৮২০টি শেয়ার রয়েছে।

সিঙ্গার বিডি : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১৫.৮১ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯১টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ১ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার ৩৯৯টি শেয়ার রয়েছে।

লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ১৯.৭০ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১১৬ কোটি ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ২২ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৮০টি শেয়ার রয়েছে।

ফুওয়াং সিরামিকস : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ৫২.৬১ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ১১ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৫ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার ৯০১টি শেয়ার রয়েছে।

ফুওয়াং ফুডস : কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ৮৮ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ৯ কোটি ১৬ লাখ ২ হাজার ৭১২টি। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৮ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার ৩৮৯টি শেয়ার রয়েছে।