tanary lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে নিজস্ব কাঁচামালের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে দেশেরট্যানারি শিল্প। এ শিল্পের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিশাল সুযোগ থাকলেও এটি এখন সঙ্কটময় সময় পার করছে বলে মনে করছে খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যানারি ও ট্যানারিজাত পণ্যের রফতানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া বেশ দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে এ শিল্পে শ্রমের নিম্ন উৎপাদনশীলতা, ব্যবসায় উচ্চ ব্যয়, মূল নকশাকারকের অভাব ইত্যাদি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এছাড়া নতুন নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, ফলে পিছিয়ে পড়ছে এ খাত। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে বড় বাজারগুলোতে আকাশপথে পরিবহনের ক্ষেত্রে সরাসরি কার্গোর অভাব আর অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বিষয়টি প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের ট্যানারিজাত পণ্যের রফতানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় । এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া বেশ পণ্য বিকশিত ও বৈচিত্রপূর্ণ হওয়ার অপার সম্ভাবনা থাকলেও এসব কারণে পণ্যটির রফতানির বাজার হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে লাভজনক আরেকটি খাত সৃষ্টির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, নতুন উদ্যোক্তারাও এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলমান সঙ্কট কটিয়ে উঠে সম্ভাবনার দিকটি বিবেচনায় এনে বেশকিছু বিষয়ে সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য ট্যানারিজাত পণ্য রফতানিতে নগদ অর্থ প্রণোদনা ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা।

এছাড়া বন্ড সমস্যা সমাধান, কাস্টমস থেকে দ্রুত ছাড়পত্র প্রদান, পরিবেশ অধিদফতরের কাছে কারখানাগুলোকে কমলা রঙ শ্রেণি থেকে সবুজ রঙে উন্নীত করা, রফতানি ঋণের জটিলতা দূর করার ব্যাপারেও সুপারিশ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ এ বিষয়ে বাংলাদেশ বলেন, আমরা তো ফুটওয়ার অ্যান্ড লেদার ইন্ডাস্ট্রিকে চামড়া প্রভাইড করি। ট্যানারি শিল্প হুট করে সাভারে স্থানান্তরের জন্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন একেবারে কমে গেছে। এখন পর্যন্ত সাভারে মাত্র ২৩টি ট্যানারি পুরোপুরি উৎপাদনে গেছে। বাকিগুলো গ্যাস সংযোগ পায়নি, অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে তারা উৎপাদনে যেতে পারেনি।

শাহীন আহমেদ বলেন, ২৩টি ট্যানারি দিয়ে তো আর টোটাল বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পকে সাপোর্ট দেয়া যাবে না। এজন্য অনেক পাদুকা কোম্পানি বাইরে থেকে চামড়া আমদানি করে কাজ করছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে তারা লসের (লোকসান) মুখোমুখি হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে কোম্পানি লস করবে। ফলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার নিতে পারবে না।

তিনিআরও বলেন, বর্তমান বিশ্ববাজার হলো প্রতিযোগিতার বাজার। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আমাদের বিদেশি বায়াররা (ক্রেতারা) প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়বে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজিকরণের সুযোগ পাওয়া যায় না। গত দুই মাস ধরে চট্টগ্রামে অসহনীয় যানজট চলছে। ফলে এ শিল্প অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে এ সেক্টর আগামীতে হুমকির মুখে পড়বে।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের জন্য চামড়াজাতপণ্য ও পাদুকা শিল্পকে জাতীয়ভাবে বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি সরাসরি আমাদের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। যেখানে আমরা বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাশনপণ্য প্রস্তুত করতে পারছি।

ট্যানারিজাত পণ্য ও পাদুকা রফতানি বিগত কয়েক বছরে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। চামড়াজাত পণ্য মোট রফতানির ৩৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর পাদুকা রফতানি মোট রফতানির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, তৈরি পোশাকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা কমিয়ে বহুমুখী পণ্য থেকে ৩০ শতাংশ আয় অর্জন করা সম্ভব। আর ৩০ শতাংশ আয়ের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য থেকেই ১০ শতাংশ আয় অর্জন হতে পারে।

১৯৮১ সালে দেশের মোট রফতানির ৭০ শতাংশ ছিল পাট ও পাটজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে পোশাক আর চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাসহ নানা ধরনের পণ্য রফতানি শুরু হয়। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে চলে আসা চামড়া শিল্প বাংলাদেশের প্রথম দিকের শিল্পগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো চামড়া খাত থেকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রফতানি আয় ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালের মধ্যে রফতানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয় ওই প্রতিবেদনে। বর্তমানে এ খাতের রফতানি আয় এক দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল এক দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।

বিগত পাঁচ বছরের এ শিল্পে গড় প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। চামড়া খাত এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা মোট রফতানি আয়ের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। আর জিডিপিতে এর অবদান দাঁড়িয়েছে এক শতাংশের ওপরে। চামড়া খাতে রয়েছে প্রায় ২২০টি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা।

এ শিল্পে নারীসহ প্রায় ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া খাতের কাঠামোগত বেশ কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে- ফিনিশড চামড়া, চামড়াজাতপণ্য ও পাদুকা। ২০০৮ সালে এই খাত থেকে মোট রফতানি আয়ের ৬২ শতাংশ এসেছে ফিনিশড চামড়া থেকে। কিন্তু ২০১৬ সালের মধ্যে তা ক্রমশ কমে আসে। অর্থাৎ এই হার ২৪ শতাংশে নেমে আসে।

প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো ট্যানারিজাত পণ্য রফতানি করছে। বর্তমানে যেসব দেশে বাংলাদেশের ট্যানারিজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে এর মধ্যে রয়েছে- জাপান, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, স্পেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। বিকাশমান বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে- তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে ট্যানারি খাতে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ খাতের ৩ কোম্পানির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে, কমেছে ২টি কোম্পানিতে। অপরদিকে একটি কোম্পানি এখনও তাদের তথ্য আপডেট করেনি। চলতি বছরের আগস্ট মাসে কোম্পানিগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগের তথ্য পর্যালোচনায় এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় অনেক বিনিয়োগকারীর মধ্যে ধীরে ধীরে আস্থার সঞ্চার হচ্ছে। নানবিধ সংস্কারের কারণে দেশের পুঁজিবাজার অনেকটাই বিনিয়োগ উপযোগী হয়ে উঠেছে। যে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে সক্রিয় হচ্ছেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যদিও ঈদ-উল-আজহা পরবর্তী সময়ে ট্যানারি ব্যবসায় কিছুটা মন্দা সময় পার করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তবে এই সমস্যা পুঁজিবাজার তালিকাভ্ক্তু কোম্পানিকে খুব একটা প্রভাবিত করবেনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানারি খাত বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। রপ্তানিকারক এ খাতটি বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। কিন্তু অন্যান্য খাতের তুলনায় এ খাতটি অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের সহায়তা পেলে এ খাতের কোম্পানিগুলো ভাল করবে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভ্ক্তু কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশী বিনিয়োগ আসার অর্থ হলো বাজারে সকলের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে এবং এই আস্থাই দেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার আভাস দিচ্ছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ট্যানারি খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেডে। আগের মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে ১৪.০৫ শতাংশ। এরপর বিনিয়োগ বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি বাটা সু। এ মাসে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ বেড়েছে দশমিক ৯৮ শতাংশ। এপেক্স ফুটওয়রে বেড়েছে দশমিক ৮৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ার বিভাগের প্রধান শাহ আলম স্বপন বলেন, চামড়া শিল্পের বর্তমান যে সময়টি যাচ্ছে তাতে কোম্পানিগুলোর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পরবে না। কারণ আমরা সরাসরি কাঁচামালটা সরবরাহ করিনা। সেদিক দিয়ে আহামরি কোনো প্রভাব পরবে না বাজারে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি অবশ্যই ইতিবাচক হবে বাজারের জন্য। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারা কিনছে সে সম্পর্কিত কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই।

অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি কমেছে ফরচুন সুজ লিমিটেডে। আগের মাসের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমেছে ১১ শতাংশ। আর এপেক্স ট্যানারিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমেছে ৪.৫১ শতাংশ।