western-marinআমিনুল ইসলাম, মহিউদ্দিন ফারুক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশে ও বিদেশে ব্যবসার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশলী খাতের কোম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোম্পানি। ফলে এ কোম্পানিটি নিয়ে  বিনিয়োগকারীদের মাঝে নতুন আশার আলো জেগে উঠছে। জাহাজের প্রধান ক্রেতা ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পর গত দুই বছরে সক্ষমতার চেয়ে অধিকসংখ্যক জাহাজ তৈরির অর্ডারও রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের হাতে।

এছাড়া গত পাঁচ বছরে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে বাংলাদেশ ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা আয় করেছে। আলোচ্য সময় বিভিন্ন দেশে ৪০টি জাহাজ রপ্তানি করে এই আয় হয়েছে। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘জাহাজ নির্মাণের ঐতিহ্য ছিল আমাদের। সেই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য আবার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মান শিল্পের এক সম্ভাবনায় দেশ। ওয়েস্টার্ন মেরিন এখন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩৫টি জাহাজ নির্মাণ করছে, যা আমাদের গৌরবের।

সাখাওয়াত হোসেন জানান, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা রপ্তানিমূল্যের জাহাজটি উচ্চপ্রযুক্তির। এই জাহাজটি নির্মাণে বিশ্বের ২৫টি দেশ থেকে উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। জাহাজটিতে হেলিপ্যাডও রয়েছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এ কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেড় শতাধিক আন্তর্জাতিকমানের জাহাজ নির্মাণ করেছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এর মধ্যে ১২০টি জাহাজ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহত হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৫টি জাহাজ রফতানি করেছে। এর মাধমে কোম্পানিটি প্রায় আট কোটি মার্কিন ডলার বা ৬৪০ কোটি টাকা আয় করেছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের টেকনিক্যাল পরিচালক আরিফুর রহমান খান এ প্রসংগে বলেন, আমাদের তৈরিকৃত জাহাজের গুণগত মান ভালো হওয়ায় এখন দেশি-বিদেশি শিল্পগ্রুপ আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এমনকি রাষ্ট্রীয় সংস্থার জাহাজও নির্মাণ করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন।

কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কোম্পানিটি চলতি বছরে সরকারি ও দেশি-বিদেশি জাহাজ তৈরির অর্ডার পেয়েছে। আর এ কাজ সম্পন্ন করতে উৎপাদনসক্ষমতা আরও বাড়াতে হচ্ছে কোম্পানিটির। নিয়োগ করতে হচ্ছে অতিরিক্ত জনবল। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে ব্যবহারের জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষায়িত জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছে চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। জাহাজটিতে মাছ ধরা ও সংরক্ষণের অত্যাধুনিক যন্ত্র সংযোজন করা হবে। এর মাধ্যমে উচ্চপ্রযুক্তির মাছ ধরার জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পেল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ এস আলমের জন্য ২০টি লাইটার জাহাজ নির্মাণ করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এছাড়া চট্টগ্রামের পায়রা বন্দরের জন্য জাহাজ নির্মাণ করতে যাচ্ছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এ নৌযানটি হবে ৩৩.৫০ মি. দীর্ঘ।

এরপর ২০১৪ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে সাড়ে চার কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে। আইপিওতে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতি শেয়ারের জন্য ৩৫ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৫ টাকা প্রিমিয়াম।

পুঁজিবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যাংকঋণ পরিশোধ, অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় বাবদ খরচ করা হলেও ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন করায় কাক্সিক্ষত জাহাজ তৈরির অর্ডার পায় কোম্পানিটি। গুণগত মান ঠিক রেখে যথাসময়ে দেশি-বিদেশি জাহাজগুলো ডেলিভারি দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে কোম্পানিটি সক্ষম হলেও উচ্চ সুদে নেওয়া ঋণের ঘানি কিছুটা টানতে সম্প্রতি জেড ক্যাটাগরির চলে যায়।

সর্বশেষ নিরীক্ষিত হিসাব বছরে আগের বছরের তুলনায় কর-পরবর্তী মুনাফায় ৭০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। নিট রেভিনিউ ১০ শতাংশ বাড়লেও উত্পাদন খরচ ও পরিচালন ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ায় মুনাফা বেড়েছে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটির।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে কার্যাদেশ বাড়ায় ২০১৬ সালে কোম্পানির মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দাবস্থা কাটিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জাহাজ শিল্প। ২০১৬ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিনের আন্তর্জাতিক কার্যাদেশ আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানির টার্নওভার বেড়েছে। পাশাপাশি পরিচালন দক্ষতার কারণে উত্পাদন ব্যয় কমে এসেছে।

এ সময় স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্যাসেঞ্জার ভেসেল ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বার্জ ও টাগবোট নির্মাণের কার্যাদেশ এসেছে। পাশাপাশি উগান্ডা, গাম্বিয়া ও দুবাই থেকে জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন।

সর্বশেষ প্রকাশিত ওয়েস্টার্ন মেরিনের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে কোম্পানির নিট রেভিনিউ দাঁড়িয়েছে ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, আগের বছর যা ছিল ২৫৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। জাহাজ নির্মাণ বাবদ খরচ বাদ দিয়ে আলোচ্য সময়ে কোম্পানির গ্রস মুনাফা হয়েছে ৮৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা, আগের বছর যা ছিল ৭৪ কোটি ১২ লাখ টাকা।

বিক্রি ও গ্রস মুনাফা বাড়লেও পরিচালন ব্যয় কমেছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের। ৩০ জুন সমাপ্ত ২০১৬ হিসাব বছরে পরিচালন বাবদ কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা, আগের বছর যা ছিল ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

ফলে কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া আর্থিক ব্যয়, কর পরিশোধ ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিল অর্থ সংরক্ষণের পর ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, আগের বছর যা ছিল ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ৩০ জুন সমাপ্ত ২০১৬ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২ টাকা ৪৮ পয়সা, আগের বছর যা ছিল ১ টাকা ৬৫ পয়সা।

বিলম্বিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজনে আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর একসঙ্গে দুই হিসাব বছরের লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। প্রকাশ করা হয় বার্ষিক ফলাফলও। ২০১৫ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের জন্য ১০ এবং পরবর্তী ২০১৬ হিসাব বছরের জন্য ১২ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি।

গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় এবং সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত চিটাগং বোট ক্লাবে উভয় বছরের এজিএম আয়োজন করে কোম্পানিটি। এজন্য রেকর্ড ডেট ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর।

এদিকে সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির বিক্রি ২১৩ কোটি ৬২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২০৯ কোটি টাকা। জুলাই থেকে মার্চ সময়ে কোম্পানির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ সময়ে ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ২ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ টাকা ৭৯ পয়সা।

ডিএসইতে রোববার ২ দশমিক ১০ শতাংশ কমে সর্বশেষ ৩৭ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শেয়ার। সমাপনী দর ছিল ৩৭ টাকা ৭০ পয়সা। গত এক বছরে এর দর ২২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৫০ টাকায় ওঠানামা করে।

২০১৪ সালে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ১২০ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। রিজার্ভ ১৭৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট ১২ কোটি ৫ লাখ ৭ হাজার ৯০টি শেয়ারের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৩১ শতাংশ উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১২ দশমিক ৪৫ এবং বাকি ৫০ দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।

বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ও বাজারদরের ভিত্তিতে এ শেয়ারের মূল্য-আয় (পিই) অনুপাত ১৫ দশমিক ২, হালনাগাদ অনিরীক্ষিত মুনাফার ভিত্তিতেও তা ১৫ দশমিক ২।