Centralpharmaমোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মালিকানা হস্তান্তরে আলিফ গ্রুপের কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী নি:স্ব হয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আলিফ  গ্রুপের এ কেমন প্রতারনা!

আজ সিকিউরিটিজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে এ কথা শোনা যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা একজন আরেকজনকে বলতে শোনা যাচ্ছে তা হলে কি আলিফ গ্রুপ সেন্টাল ফার্মার শেয়ার নিয়ে কারসাজি করতে এমন চুক্তি করেছিল।

সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার পুঁজিবাজারে আসার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে ২১ টাকার ঘরে ক্রয় বিক্রয় হতে থাকে। হঠাৎ করে পুঁজিবাজারের নিন্মমুখী প্রবনতা ও কোম্পানির অবস্থা নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে চলতে থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দর গত ডিসেম্বর মাসে ১৫ টাকার নিচে নেমে আসে।

এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে গুজব রটতে থাকে, কোম্পানির মালিকানা আলিফ  গ্রুপ কিনে নিচ্ছে। এরপর ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের কবলে পড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। গুজব শুরুর ২ মাস পর গত ২০ ফেব্রæয়ারীতে স্টক এক্সচেঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে খবর আসে, আলিফ  গ্রুপ কোম্পানিটির মালিকানা কিনে নিচ্ছে।

ওইদিন ২০ ফেব্রæয়ারী কোম্পানিটির শেয়ার দর উঠে ৩৩ টাকায়। মালিকানা পরিবর্তনের খবর আসার পর কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩৬ টাকার বেশি উঠে। এরপর টানা দুই মাসেরও বেশি সময় কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩০-৩২ টাকায় লেনদেন হয়। এরমধ্যে আলিফ গ্রæপ কর্তৃপক্ষ, সেন্ট্রাল ফার্মা কর্তৃপক্ষ এবং স্বার্থান্বেষী মহলের পোয়া বারো। তারা কোম্পানিটিকে জুয়ার কোর্ট বানিয়ে পুঁজিবাজার থেকে কোটি টাকা লুটপাট করে সটকে পড়ে। আর ক্ষতিগ্রস্থের কবলে পড়ে যায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এরপর বাজারে ভিন্ন খবর আসতে থাকে-আলিফ  গ্রুপ কোম্পানিটির মালিকানা কিনছে না। তারপর থেকেই ক্রামগত পতনে থাকে সেন্ট্রাল ফার্মার শেয়ার দর। ৩৬ টাকার শেয়ার ৬০ শতাংশের বেশি দর হারিয়ে যখন ২২ টাকার ঘরে চলে এসেছে, তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে গত সোমবার বিকালে খবর এলো আলিফ গ্রুপ কোম্পানিটি কিনছে না। এর মধ্যে যা হবার তাই হয়েছে।

শেয়ারবাজারের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী পথে বসে গেছে। অন্যদিকে, আলিফ  গ্রুপ, সেন্ট্রাল ফার্মা  গ্রুপ স্বার্থান্বেষী মহল কোম্পানিটিকে জুয়ার কোর্ট বানিয়ে পুঁজিবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরী। যাতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। অন্যথায়, তালিকাভুক্ত অন্যান্য কোম্পানিও সেন্ট্রাল ফার্মার পথে অনৈতিকভাবে হাঁটতে শুরু করতে পারে।

জানা যায়, সেন্ট্রাল ফার্মার মালিকানা আলিফ  গ্রুপের কাছে হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। গত সোমবার সেন্ট্রাল ফার্মা কর্তৃপক্ষ জানায়, শুরুতে যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও এমওইউ স্বাক্ষরের আট মাস পেরিয়ে গেলেও আলিফ  গ্রুপ তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। দীর্ঘসূত্রতার কারণে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেছে।

স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ফার্মা জানায়, ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি আলিফ গ্রæপের বিভিন্ন পরিচালক ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সেন্ট্রাল ফার্মার পর্ষদ তাদের নিজেদের অংশের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এমওইউ স্বাক্ষর-পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলিফ গ্রæপের দীর্ঘসূত্রতার কারণে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে।

তবে আলিফ গ্রুপের  ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সেন্ট্রাল ফার্মার মালিকানা কেনার ব্যাপারে আলিফ  গ্রুপ আগ্রহী হলেও কোম্পানিটির বিদ্যমান অবস্থার উন্নতির জন্য কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব শর্ত পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ অবস্থায় আলিফ গ্রুপের পক্ষে সেন্ট্রাল ফার্মার মালিকানা কেনার বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের ২২ ফেব্রæয়ারি স্টক এক্সচেঞ্জ মারফত সেন্ট্রাল ফার্মা জানিয়েছিল, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পাঁচজন পরিচালকই তাদের সব শেয়ার আলিফ গ্রæপ বা এর কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিচালকদের কাছে বিক্রি করে দেবে। বøক মার্কেটে শেয়ার হস্তান্তর শেষে চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগসহ নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে আলিফ গ্রুপ। তবে কবে নাগাদ শেয়ার হস্তান্তর বা নতুন পরিচালনা পর্ষদ আসবে, এ বিষয়ে সে সময় কিছু জানানো হয়নি।

জানা যায়, বাংলাদেশে ব্যবসা করা ইউরোপীয় ও মার্কিন কোম্পানি গেটকো ও বাংলা ক্যাটের হাত ধরে আশির দশকে সেন্ট্রাল ফার্মার যাত্রা হয়। পরবর্তীতে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হয়ে ১৯৯৩ সালে স্থানীয় মেট্রো  গ্রুপের  কাছে কোম্পানিটির মালিকানা হস্তান্তর করে গেটকো। এরপর পুরনো যন্ত্রপাতির সঙ্গে নতুন যন্ত্রপাতি বসিয়ে ১৯৯৪ সালে মেট্রো গ্রুপের অধীন নতুন করে উৎপাদনে আসে কোম্পানিটি।

ওই সময় সেন্ট্রাল ফার্মার পরিচালক হিসেবে যোগ দেন বর্তমান এমডি মনসুর আহমেদ। তবে কয়েক বছর পরই মনসুর আহমেদের কাছে সম্পূর্ণ মালিকানা হস্তান্তর করে দেয় মেট্রো গ্রæপ। এরপর তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে ২০০২ সাল থেকে নতুন উদ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ১৫ বছরের মাথায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী আবারো মালিকানা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বর্তমান পর্ষদ।

অন্যদিকে দেশের বস্ত্র, তৈরি পোশাক, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান, আবাসন, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ রয়েছে আলিফ গ্রæপ। এরই মধ্যে গ্রুপ মূল বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সিএমসি কামাল টেক্সটাইলস মিলস এবং ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বাজারে থাকা কোম্পানি সজিব নিটওয়্যার লিমিটেড কিনে নিয়েছে। আলিফ গ্রæপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. আজিজুল ইসলাম। তাছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তার ছেলে মো. আজিমুল ইসলাম।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সেন্ট্রাল ফার্মার ১০ কোটি ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৫টি শেয়ারের মধ্যে বর্তমান পরিচালকদের কাছে ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৩ দশমিক ২৯ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫৬ দশমিক ৭১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।