dse-cseআমিনুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে নতুন আসা কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি থামছেই না। একটির পর একটি নতুন কোম্পানি বেছে নিচ্ছে তারা। মৌলভিত্তি দুর্বল হওয়া সত্তে¡ও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম। চক্রটির সর্বশেষ শিকারে হলো ওয়াইম্যাক্স ইলেক্টোডের প্রথম দিনে দর বেড়েছে ১ হাজার শতাংশের বেশি। ফলে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে বিজয়ীরা প্রথম দিনেই বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন ৬৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

তাদের আশঙ্কা, কারসাজিকারীদের পাতা ফাঁদে পা দিলেই বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তারা বলছেন, লেনদেনের প্রথম দিন থেকেই মার্জিন সুবিধা, সার্কিট ব্রেকার না থাকা, তালিকাভুক্ত নতুন কোম্পানির শেয়ারে ধারাবাহিকভাবে দাম বাড়া, কারসাজি ও বিনিয়োগকারীরা না বুঝে নতুন শেয়ারে বিনিয়োগ করার কারণে নতুন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলো ফেসভ্যালুতে বা অভিহিত মূল্যে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে শত কোটি হাতিয়ে নিচ্ছে। তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা এই বাজারের এতো বড় অঙ্কের টাকা বের হয়ে যাওয়াকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বড় মূলধনী কোম্পানি কিংবা প্রিমিয়াম দিয়ে হলেও ভাল কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সম্প্রতি তিনটি কোম্পানিটির প্রথম দিনেই কয়েকশ শতাংশ দর বেড়েছে ঐ টাকার বেশিরভাগই বাজার থেকে আইপিও বিজয়ীরা তুলে নিয়েছেন। এভাবেই ফেসভ্যালুতে আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর শেয়ার স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে একটি পক্ষ বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, সেকেন্ডারি মার্কেটে কোন কোম্পানির এভাবে দরবৃদ্ধি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কারণ কোম্পানিটি যদি এতোই ভালো হতো তাহলে আইপিও অনুমোদনের সময়ই প্রিমিয়াম দাবি করতো। এখন প্রিমিয়াম চাইলে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। সেখানে যোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিলামের মাধ্যমে দর নির্ধারণ করে থাকেন। পরে কাট অফ প্রাইসের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আইপিও আবেদন করতে পারেন।

সেক্ষেত্রে কোম্পানির প্রিমিয়ামের টাকা কোম্পানিরি রিজার্ভ ও এনএভিতে যোগ হতো কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতো। কিন্তু অভিহিত মূল্যে আসার পরে কোম্পানির দর বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির কোন কাজে আসে না। উল্টো আইপিও বিজয়ী বিনিয়োগকারীরা প্রথম দিনে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিয়েছেন।

এদিকে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো কারসাজির ফলে শেয়ার লেনদেনের শুরু থেকেই সার্কিট ব্রেকার আরোপ করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আইপিওতে আসা কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে এমন পরিকল্পনা করছে কমিশন।

বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, আইপিও-তে আসা কোম্পানির শেয়ার লেনদেন পর্যবেক্ষণ করবে কমিশন। সেগুলোর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক শেয়ার দর বাড়লে শেয়ারবাজারের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখবে কমিশন।

স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ার দর নির্দিষ্ট দিনে কত শতাংশ বাড়তে বা কমতে পারবে, তা একটি পূর্বনির্ধারিত ফর্মুলা রয়েছে। একে সার্কিট ব্রেকার বলা হয়। ওই ফর্মুলা অনুযায়ী আগের দিনের সমাপনী দরের ওপর ভিত্তি করে ১০ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দরের সীমা আরোপ করা হয়।

ওই সীমার বাইরে সংশ্নিষ্ট শেয়ার কেনাবেচা হতে পারে না। আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করে কোনো কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তি হওয়ার পর লেনদেনের প্রথম দুই দিন শেয়ারদরে কোনো সার্কিট ব্রেকার থাকে না। অর্থাৎ ওই দু’দিন যে কোনো মূল্যে শেয়ারটি কেনাবেচা হতে পারে।

এমন সুযোগ রাখার কারণ প্রসঙ্গে সাইফুর রহমান বলেন, আইপিওতে আসা শেয়ারের যৌক্তিক মূল্য (ফেয়ার ভ্যালু) নির্ধারণ করার স্বার্থে সার্কিট ব্রেকার রাখা হয় না। বাজারকেই প্রকৃত দর খুঁজে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।

এ বিষয়ে সিটিজেন সিকিউরিটিজ এন্ড ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাহিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, নতুন কোম্পানি বাজারে আসলেই হু হু করে দাম বাড়ে। ফলে বিনিয়োগকারীরা কিছু না বুঝেই সে শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এতে করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের উচিত ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। যাতে করে তারা দীর্ঘমেয়াদে ভালো কিছু পায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এক সময় নতুন কোম্পানির শেয়ারে কোনো মার্জিন ছিল না। এখন বিএসইসি আবার প্রথম দিন থেকেই মার্জিনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এতে করে মার্জিন নিয়ে তারা নতুন কোম্পানির শেয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিএসইসির উচিত মার্চেন্ট ব্যাংক বা ট্রেকহোল্ডারদের বলে দেয়া, যাতে তারা নতুন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে মার্জিন ঋণ না দেয়।

ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আলি বলেন, সম্প্রতি তিনটি কোম্পানিটির প্রথম দিনেই কয়েকশ শতাংশ দর বেড়েছে। এতে বুঝা যায় এসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু আহমেদ বলেন, প্রথম দিন লেনদেনে আসা নতুন কোম্পানিগুলোতে কারসাজি হয় এবং এ কারণে কিছু বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর বর্তমান আইপিও বাজারের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শুরু থেকেই সার্কিট ব্রেকার রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটু নজর দেয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের কারসাজির ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য বলেন তিনি।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস ইকোনমিক্সের অধ্যাপক মুহাম্মদ মূসা বলেন, নতুন কোম্পানির শেয়ার বাজারে লেনদেন শুরু হলেই এক দল বিনিয়োগকারী কারসাজিতে মেতে ওঠে। এতে পা দেয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এক সময় তারা সব হারিয়ে ফেলে।

তিনি বলেন, এ মুহ‚র্তে এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারের দিকে নজর না দিয়ে মৌলভিত্তিক কোম্পানির শেয়ারের দিকে নজর দেয়া উচিত। আর যদি দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকে পড়ে তাহলে তাদের ধরা খাওয়া নিশ্চিত।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, সম্প্রতি কিছু কোম্পানির শেয়ার দর ইস্যু মূল্যের চেয়ে কয়েকশগুণ বেশি দরে লেনদেন হয়েছে। স্বল্প মূলধনী কোম্পানি হওয়ার কারণেই কারসাজির চক্রের সদস্যরা উচ্চদরে এই শেয়ার কিনেছেন। ফলে প্রথম কয়েক দিনেই আইপিও বিজয়ীরা শেয়ার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। তবে ক্ষতির শিকারও হয়েছেন অনেকে।
প্রিমিয়াম নেয়ার মতো কোম্পানি বা ভাল মৌলভিত্তির কোম্পানি হলে বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা তুলতো কোম্পানিগুলো।

কিন্তু মৌলভিত্তি কম হওয়ার কারণে বুক বিল্ডিংয়ে কোম্পানিগুলো বাজারে আসেনি। প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসলে প্রিমিয়ামের টাকা অন্তত কোম্পানিতে থাকত। এখন সেটি হয়নি। ফলে টাকার বড় একটি অংশ বাজারের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও এই বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।

অভিহিত মূল্যের স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোর উচ্চ মূল্যে লেনদেন সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আইপিও আবেদনকারীরা সাধারণ আইপিওতে শেয়ার পাওয়ার পর তা বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নেয়। এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের টাকা বাজার থেকে বাইরে চলে যায়।

তাই সেকেন্ডারি বাজারে যারা শেয়ার কিনবেন তাদের সতর্ক থাকতে হবে। অতি মুনাফার আশায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান তিনি। এতে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন বাজারে আসবে।