sangshadদেশ প্রতিক্ষণ,ঢাকা: আগাম নির্বাচনের পথে হাঁটছে আ’লীগ! সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের এক’বছর বাকি থাকলেও ক্ষমতাসীন দল আ’লীগ অনেকটা জোরেশোরে আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিশেষ করে সরকারি দলের কিছু পদক্ষেপ ও বক্তব্য খুবই উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি দলীয় সম্মেলন থেকে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

নেতাকর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ছাড়া টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার রেকর্ড গড়তে হবে। সে লক্ষ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্বাচনী কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করার জন্য জেলা-উপজেলায় চিঠি পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন দলের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তাই আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগামী মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের যে কোনো দিন তারিখ ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে দলটি। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এখনও প্রকাশ্যে কোনো উদ্যোগ না নিলেও পর্দার আড়ালে একেবারে সাজ সাজ রব। প্রতিদিনের বক্তৃতা বিবৃতিতে তাদের প্রধান অন্যতম এজেন্ডা এখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন। এ দাবিতে দলের সিনিয়র নেতারা প্রতিদিনই কথা বলছেন।

আর সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তো একেবারে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতির এমন চিত্রই বলে দিচ্ছে ২০১৯ সালের নির্বাচন অনেকটা আগেই হবে। পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক পূর্বাভাস তাই বলছে। গত মঙ্গলবার দলের সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা দেশ প্রতিক্ষণকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

সূত্র জানায়, প্রতিদিনের মতোই সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবীর নানকসহ কয়েকজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতারা।

এ সময় ওবায়দুল কাদের যুগ্ম সাধারণ ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছে জানতে চান, যদি মার্চে নির্বাচন করতে হয় সেক্ষেত্রে দলের সে রকম প্রস্তুতি আছে কিনা। জবাবে যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা জানান, দলের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত। মার্চে নির্বাচন হলে তাতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েই অংশগ্রহণ করা সম্ভব। এরপর যুগ্ম সাধারণ ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্বাচনী কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করার জন্য নির্দেশ দিয়ে জেলা-উপজেলা নেতাদের কাছে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তার বক্তব্য নিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘স্যার মিটিংয়ে আছেন জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলুন।’ এরপর মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘স্যার (মন্ত্রী) এ বিষয়ে এখন কথা বলবেন না।’

এদিকে পরের দিন বুধবার সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেন, ‘সেটা করা যাবে। নির্বাচনের জন্য তো ৯০ দিন সময় থাকে। আগাম নির্বাচনের বিষয়টি তো সরকারের ওপর নির্ভর করে। তারা যদি আগাম নির্বাচনের জন্য বলে, তখন আমরা পারব। ৯০ দিনের সময় আছে। আমাদের ব্যালট বক্স, যা কিছু দরকার আছে। শুধু পেপার ওয়ার্কগুলো লাগবে।’

মঙ্গলবার সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের এমন সিদ্ধান্ত এবং কাকতালীয়ভাবে পরদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে যোগসূত্রতা মেলাতে চান। তবে এ রকম ধারণা সত্য না হলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন দিকনির্দেশনা খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ নিয়মানুযায়ী নির্বাচনের এখনও এক বছর বাকি।

সে ক্ষেত্রে সময়টা ৯ মাস পিছিয়ে আনার যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা কী হতে পারে। এমন স্বাভাবিক প্রশ্নের তথ্যানুসন্ধানে নেমে আপাতত তিনটি কারণ চিন্তার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সূত্র মতে, অন্তত তিনটি চিন্তা থেকে আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রথমত, তাদের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। তাই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে ওঠার আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করলে আওয়ামী লীগ ঘরে ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু দেরিতে নির্বাচন হলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে চাঙ্গা হওয়ার অনেক সুযোগ পাবে।

যার উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঢাকা-কক্সবাজার রোডশো এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ আয়োজনের বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে। এ দুটি কর্মসূচিতে অংশ নেয়া বিপুলসংখ্যক লোক সমাগমের দৃশ্য বলে দেয় ভবিষ্যতে আট বিভাগীয় সমাবেশে কী হবে। এটি যদি ভাবার বিষয় হয় তাহলে ভোটের মাঠের হিসাব-নিকাশে সে সুযোগ বিএনপিকে কেন দেবে সরকারি দল।

দ্বিতীয়ত, মার্চ এবং ডিসেম্বর মাস হল যথাক্রমে স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাস। মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিবস ও জন্মদিবস, স্বাধীনতা দিবস। এ মাসে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেশি সক্রিয় থাকে যা অনুরূপভাবে থাকে, ডিসেম্বরেও। এই সেন্টিমেন্টকে ধারণ এবং কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী মাঠে সফল হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য কিছুটা শাপেবর। হতে পারে, এজন্য মার্চকে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয়ার চিন্তা রয়েছে।

সর্বশেষটি হল, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্ধারিত সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগেই আসন্ন রংপুর ছাড়াও আরও ছয়টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ রয়েছে।

কিন্তু কোনো কারণে যদি সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের ঘরে কাক্সিক্ষত ফল না আসে সেটি নির্ঘাত জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, রংপুর সিটি নির্বাচনে হয়তো শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি জয় ছিনিয়ে নিতে পারে। স্থানীয়ভাবে এমন আভাস রয়েছে।

কিন্তু খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ফলাফল কী হবে। আগামী বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে এ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা।

অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব সিটির নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সঙ্গত কারণে সিটি নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বেই। সেক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে জয়ের পাল্লা বিএনপির দিকে ভারি হয়ে যায় তাহলে দেশজুড়ে সাধারণ ভোটারদের কাছে ভিন্ন বার্তা যাবে।

আবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসির ভূমিকা বিতর্কিত হয়ে পড়লে এই কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা নিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আওয়ামী লীগের আগাম নির্বাচন করার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণে রয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সবই ধারণাভিত্তিক অনুমাননির্ভর আগাম মন্তব্য ছাড়া কিছু নয়। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, এটি নিছকই খসড়া একটি আলোচনা মাত্র।

কেননা আগামী জানুয়ারিতে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বসবে যেখানে রাষ্ট্রপতি উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন। আর সে আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গত চার বছরে সরকারের অর্জন তুলে ধরার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না।

তার মতের অনেকটা কাছাকাছি মতামত দেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ২০১৯-এর জানুয়ারিতে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। নিয়মানুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হয়।

যদিও প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলে আগে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন তিনি। সেক্ষেত্রে সংবিধানের ১২৩ ধারা অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা মানতে হবে। কিন্তু দেশে এমন কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তা ভেঙে দিতে হবে।