dse dorpotonদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে টানা কয়েক কার্যদিবস ধরে দরপতন চলছে। কোন কারন ছাড়াই টানা পড়ছে শেয়ারের দর। ফলে বাজারের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে দু:চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সহ ডিএসই সিএসইসি নিরব আচরন করছেন। দরপতনের বাজারে তাদের আচরন নিয়ে সন্দেহ চলছে। বাজারের এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে নতুন বিনিয়োগকারীরা ফের বাজারবিমুখ হয়ে পড়বে।

২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে বাজার বারবার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও তা স্থায়ী হয়নি। বরং এই ইঙ্গিতে যখনই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বাধেন, তখনই কারসাজির হোতারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু নয় বলে ধারণা করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, কোন ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই বাজারে সূচকের উলম্ফন এবং কয়েকদিনের ব্যবধানেই এর নিম্নগতি কারসাজিরই ইঙ্গিত করে। এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশনের (বিএসইসি) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

তাদের মতে, আবারো পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কায় আতঙ্কিত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর এজন্য বরাবরের মতো এবারো অভিযোগের তীর বিএসইসি ও কারসাজি চক্রের দিকে। তারা জানান, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কারসাজি থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। এ কারসাজি চক্র পরিকল্পিতভাবে বাজার বিপর্যস্ত করছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বর্তমান অবস্থাকে সাপলুডু খেলা বলেও মন্তব্য করেছেন। কারণ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তিল তিল করে কষ্টার্জিত পুঁজি দিয়ে শেয়ার কেনার পর বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরে। আর ঠিক তখনই কারসাজি চক্র বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে বাজার নিম্নমুখী করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে নিয়েও কারসাজিতে তৎপর রয়েছে এসব গোষ্ঠি। আর এভাবেই নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টির আড়ালে কারসাজি চক্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে চলেছে।

একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বাজার যখনই কিছুটা উর্ধ্বমুখী হয় ঠিক তখনই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সাইনবোর্ড লাগিয়ে কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি শুরু করে, ফলে শুরু হয় দরপতন। এ চক্রকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিহ্রিত করা উচিত।

এদিকে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা বর্তমান অবস্থাকে সাপলুডু খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে শেয়ার কিনে সূচককে মইয়ের ওপর তোলার চেষ্টা করে, আর ঠিক তখনই একটি সংঘবদ্ধ চক্র তা সাপ হয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে আবার সূচক নিম্নমুখী হয়। তারা আরো বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

কারণ বাজারের ক্রান্তিকালে বিশেষ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন আস্থা সংকটে ভোগেন, তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেশ জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ থেকেছে।

তারা জানান, পুঁজিবাজারে কারসাজি চক্রকে যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে। তা না হলে দেশের সম্ভাবনাময় এ খাতটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আর এসব বিষয় সামনে রেখেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এগিয়ে যেতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী এক শ্রেনীর অসাধু মহল বিভিন্ন গুজবের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। এ কারণে বাজারে স্থায়ী স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না। কাজেই তিনি বিনিয়োগকারীদেরকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ বলেন, সার্বিক দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল। তবে টানা দরপতন বাজারের জন্য শুভ লক্ষন নয়। এছাড়া বিনিয়োগকারীরা হুজেগে শেয়ার বিক্রির ফলে দরপতন ত্বরান্বিত হয়েছে। এছাড়া দেশে এমন কোন পরিস্থিতি হয়নি। যার জন্য টানা দরপতন থাকবে। তিনি মুদ্রানীতিকে পুঁজিবাজার বান্ধব বলে উল্লেখ্য করেন।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে টানা দরপতন চলছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিস্ক্রিয়তায় টানা দরপত চলছে। বাজার যখনই কিছুটা উর্ধ্বমুখী হয় ঠিক তখনই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সাইনবোর্ড লাগিয়ে কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি শুরু করে, ফলে শুরু হয় দরপতন।

উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা বলেন, কারসাজি চক্রের হোতারা প্রথমে স্ক্রিনে যে পরিমাণ বায়ার থাকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী শেয়ার ছাড়তে থাকে, এরপর নিজেরা বায়ার হয়ে আরো কম দরে শেয়ার কিনে এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করতে থাকে। তখন কারসাজি চক্র নিজেরা শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার কিনতে থাকে। এভাবেই নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

দ্বিতয়ত, ব্যাংকের বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বাজারে তারল্য সংকট বিরাজ করছে। আগে কিছু ব্যাংকের বিনিয়োগের মাত্রা যা ছিল তার থেকে এখন অনেক কমে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকগুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমে গেছে। কারণ তাদের বিনিয়োগ সীমাসংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কিছু বিধি-নিষেধ ছিল।

তবে বাজারে যারা অনেক বড় ব্যক্তি বিনিয়োগকারী আছেন তারা অনেকেই বলেন, প্রতিদিন লেনদেনের সময়ের পরে কে কী শেয়ার কোন হাউজ থেকে কতগুলো কিনেছেন, তার সব তথ্য ফাঁস অর্থাৎ সবাই জেনে যাচ্ছে। এ তথ্যগুলো আবার কেনাবেচাও হয়। আর এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনা হলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। কোথা থেকে তথ্য যাচ্ছে, তাও হয়তো অনেকেরই জানা।

কিন্তু এটি বন্ধ হচ্ছে না। আর যখন একজন বিনিয়োগকারী জানে যে, অমুকের কাছে এত শেয়ার হোল্ড আছে তখন অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পান। যে কারণে বিনিয়োগের ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি উৎপাদন নেই এমন কোম্পানির শেয়ারদর অযৌক্তিক হারে বাড়ছে। আজ টপ টেনে ফান্ডামেন্টাল কোম্পানি খুব বেশি ছিল না। বিষয়টি বাজারের জন্য ভালো নয় বলেও মনে করছেন তারা।

তৃতীয়ত, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ শেয়ার কেনা হয়েছে ঊর্ধ্বগতি বাজারের সুযোগ নিয়ে তারা মুনাফা বের করে নিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি হওয়ায় সামগ্রিক বাজারের এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাজারের টানা দরপতন প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বাজারের টানা দরপতন হলে বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই নিরব কেন। টানা যখন সুচকের বৃদ্ধি ছিল তখন কেন দর বাড়ছে এ কারন জানতে চায়। এখন দরপতন হলে কেউ কোন ভ্রুক্ষোভ নিচ্ছে না।

তারা আরো বলেন, এভাবে প্রতিদিন শেয়ারপ্রতি ২০ পয়সা, ৩০ পয়সা কমতে থাকলে সপ্তাহ শেষে মোটের ওপর বড় ধরনের লোকসানে পড়বেন। এমনিতেই তারা লোকসানে রয়েছেন। এরপর সূচকের পতন হলে তাদের ধৈর্য থাকবে না। ফোর্সসেল দিয়ে অনেকেই বের হয়ে যাবেন। বড় ধরনের পতনের মুখে পড়বে বাজার।

এ অবস্থায় বাজার-সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেয়া উচিত। বাজারে ধস শুরু হলে উদ্যোগ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা নেওয়া জরুরি বলেও মনে করছেন তারা।