bank lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অধিকাংশ ব্যাংকই পরিচালন মুনাফা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থগিত সুদ হিসাবকে আয় হিসাবে দেখানো এবং খেলাপি ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখিয়ে এ কাজ করেছে বলে মনে করেন তারা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, পরিচালন মুনাফায় প্রকৃত তথ্য আসে না। এখানে কিছুটা শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে। ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা হল নিট মুনাফা। তবে বিদায়ী বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার উল্লম্ফন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই আগের বছরের চেয়ে মুনাফা বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। পরিচালকদের চাপে নির্ধারিত ল্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংকারদের কর্মদতা দেখাতে ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ব্যাংকাররা মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অনেক ব্যাংকে মুনাফার হিসাবে ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাড়তি মুনাফা বাদ দিতে বাধ্য করেছে। ফলে অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে।

ব্যাংকগুলোর প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মুনাফা দেখিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এর পরেই আছে পূবালী ব্যাংক ৯১৫ কোটি টাকা ও আল আরাফা ব্যাংক ৮০৯ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বছরের শেষ দিনে ব্যাংকগুলো তাদের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব করে থাকে। বের করে তাদের পরিচালন মুনাফা। তবে এ মুনাফা একেবারেই প্রাথমিক হিসাব। প্রকৃত মুনাফা আরো কমে যাবে। যথাযথভাবে খেলাপি ঋণের হিসাব করা হলে এবং এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হলে এটি তিন ভাগের এক ভাগও থাকবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের দুই বছরের চিত্রে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা দেখায়। কিন্তু প্রকৃত মুনাফার পরিমাণ দেখা যায় মাত্র সাত হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রথমে দেখানো ২৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটিতে নামে প্রকৃত মুনাফা।

এই মুনাফা থেকেই শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকগুলো। ফলে নতুন বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলো যে উচ্চ মুনাফা ঘোষণা করে, সে অনুপাতে লভ্যাংশ দিতে পারে না। এতে আশাহত হন বিনিয়োগকারীরা।

যেভাবে মুনাফায় কারসাজি : ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের দায় মেটাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো আদায় হচ্ছে না। ফলে এগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকের প্রভিশন সংরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতেই য়ে যাচ্ছে মুনাফা।

এর বাইরেও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় দেখিয়ে, আমানতের সুদের বিপরীতে সংরতি প্রভিশন ও ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য সুদকে আয় হিসাবে দেখিয়ে মুনাফার চেহারা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া বেআইনিভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করে মুনাফার অঙ্ক বাড়াচ্ছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তদন্তে ধরা পড়ার পর এগুলো ফেরত দেয়ার নজিরও রয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকের হিসাবে বিভিন্ন টার্ম রয়েছে। মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ ‘পে-অ্যাবল’ হিসেবে প্রভিশন করতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পে-অ্যাবল হিসেবে রাখা টাকাকে আয় খাতে প্রদর্শন করছে। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভ-অ্যাবল’ হিসাবে টাকা রাখা হয়।

ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভ-অ্যাবল আয় হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কেই আয় প্রকৃতপে না হলেও তা আয় হিসাবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বাড়ছে মুনাফার হিসাব।

কোনো ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় না হলে তা আয় হিসাবে দেখাতে পারে না ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতেও কোনো আয় দেখাতে পারে না। এই েেত্র সুদ হিসাব করে আলাদা একটি হিসাবে জমা রাখতে হয়। কেবল আদায় হলেই তা আয় খাতে নেয়া যাবে। এর আগে নয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো সুদ আদায় না করেই কাগুজে মুনাফা আয় খাতে দেখা যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, বছরের শুরুতে পরিচালকেরা ব্যাংক নির্বাহীদের বিভিন্ন খাতে ব্যবসার একটি ল্যমাত্রা বেঁধে দেন। এটি অর্জন করতে না পারলে পদোন্নতি আটকে যায়, প্রফিট বোনাস কম পাওয়া যায়। এসব কারণে ব্যাংকাররা পরিচালকদের চাপে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন।

২০১৭ সালে ব্যাংকিং খাতে পরিচালন মুনাফা : দেশে সরকারি মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংক রয়েছে আটটি। আর বিদেশী ব্যাংক রয়েছে ৯টি। অন্য দিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক রয়েছে ৩৯টি। আর এ ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার রয়েছে সাধারণের হাতে। এ কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মুনাফা জানার আগ্রহ থাকে জনসাধারণের।

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক দুই হাজার ৪২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল দুই হাজার ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক মুনাফা করেছে ৮০৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৭১১ কোটি টাকা।

ইস্টার্ন ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭৫০ কোটি টাকা যা আগের বছরে ৭০৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। পূবালী ব্যাংক ৯১৫ কোটি টাকা, আগের বছরে ছিল ৭০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। এক্সিম ব্যাংক ৭১১ কোটি টাকা, আগের বছরে ৬১৩ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়া ৬৭০ কোটি টাকা, আগের বছরে ৫৯৩ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭১১ কোটি টাকা, আগের বছরে ৫০৬ কোটি টাকা।

এনসিসি ব্যাংক ৫৩৫ কোটি টাকা, আগের বছরে ৪৬৮ কোটি টাকা। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৪১৭ কোটি টাকা, আগের বছরে ৩৭০ কোটি টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৩৬০ কোটি টাকা, আগের বছরে ৩৫২ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংক ৪৫০ কোটি টাকা, আগের বছরে ৩৩২ কোটি টাকা। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ৩৬০ কোটি টাকা, আগের বছরে ৩১২ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক ৪৮৫ কোটি টাকা, আগের বছরে ৪২২ কোটিা টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৪৭০ কোটি টাকা, আগের বছরে ৩৭৩ কোটি টাকা।

নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ২৩০ কোটি টাকা, আগের বছরে ১৭৭ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০২ কোটি টাকা, আগের বছরে ১৫৮ কোটি টাকা। সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১৮২ কোটি টাকা, আগের বছরে ১৫২ কোটি টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক ১২০ কোটি টাকা, আগের বছরে ১০৭ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংক ১১০ কোটি টাকা, আগের বছরে ১০২ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংক ১৫১ কোটি টাকা, আগের বছরে ৯৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।