babariদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২৫ বছর আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের মাথায় উঠে শাবলের ঘা মেরেছিলেন তিনি। এখন লম্বা দাড়ি রেখে তিনি মৌলবি। ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদ মেরামত করতেন চান তিনি। এভাবেই তিনি সেই অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পেতে চান তিনি। এক সময় শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিংহ এখন হয়ে গিয়েছেন মোহাম্মদ আমির। আল্লাহর নাম সবসময় থাকে তার মুখে। ভোরে আজান দেন নিয়মিত।

বাবরির মাথায় শাবলের ঘা দেয়ার পর সব খুইয়েছিলেন বলবীর। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। না, স্ত্রীও সেই সময় তার হাত ধরে বেরিয়ে আসেননি। বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে শুনেছিলেন, বাবা নাকি বলে গিয়েছিলেন, তার দ্বিতীয় সন্তানের (বলবীর) মুখ যেন বাড়ির কেউ আর না দেখেন। এমনকী, বলবীরকে যেন তার বাবার মুখাগ্নিও করতে না দেয়া হয়।

বদলের আরেক নাম যোগেন্দ্র পাল। বলবীরের বন্ধু। ২৫ বছর আগে যিনি বলবীরের সঙ্গেই উঠেছিলেন বাবরির মাথায়। শাবলের ঘায়ে ভেঙেছিলেন মসজিদ। বহু দিন আগেই তিনিও হয়ে গিয়েছেন পুরোদস্তুর মুসলিম।

বলবীর বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তার পরিবার কোনো দিনই উগ্র হিন্দু ছিলেন না। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি- এই তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাওয়া বলবীর তার মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে ছোটবেলায় থাকতেন পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে। বলবীরের বয়স যখন ১০, তখন তিনি ও তার ভাইদের পড়াশোনার জন্য বলবীরের বাবা দৌলতরাম তাদের নিয়ে চলে যান পানিপথে।

বলবীরের কথায়, ‘‘আমার বাবা বরাবরই গান্ধীবাদে (মহাত্মা গান্ধী) বিশ্বাসী। তিনি দেশভাগ দেখেছিলেন। তার যন্ত্রণা বুঝেছিলেন। তাই আমাদের আশপাশে যে মুসলিমরা থাকতেন, উনি তাদের আগলে রাখতেন সব সময়। কিন্তু পানিপথের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা লোকজনরা তেমন মর্যাদা পেতেন না পানিপথে।’’

ফলে একটা গভীর দুঃখবোধ সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত বলবীরকে। সেই পানিপথেই একেবারে অচেনা, অজানা আরএসএসের একটি শাখার কর্মীরা বলবীরকে দেখা হলেই ‘আপ’ ‘আপ’ (আপনি, আপনি) বলে সম্বোধন করতেন।

বলবীর বলছেন, ‘‘সেটাই আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই ওদের (আরএসএস) সঙ্গে আমার ওঠবোস শুরু হয়। শিবসেনা করতে করতেই বিয়ে করি। এমএ করি রোহতকের মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময় প্রতিবেশীরা ভাবতেন আমি কট্টর হিন্দু। কিন্তু বাবা কোনো দিনই মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতেন না।

আমরা কোনো দিনই যেতাম না মন্দিরে। বাড়িতে একটা গীতা ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি বা আমার ভাইয়েরা কেউই সেটা কখনো পড়িনি। পানিপথে কেউ বাঁ হাতে রুটি খেলেও তখন তাকে ‘মুসলিম’ বলে হেয় করা হয়।’’

শিবসেনার লোকজনদের কাছ থেকে ‘সম্মান’ পেয়ে তাদের ভালো লেগে যায় বলবীরের। শিবসেনাই তাকে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল বাবরি ভাঙতে। পাঠিয়েছিল বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালকেও। তাঁরা হয়ে যান করসেবক।

বলবীর জানিয়েছেন, বাবরি ভেঙে পানিপথে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে তাকে ও যোগেন্দ্রকে তুমুল সংবর্ধনা জানানো হয়। তারা যে দু’টি ইট এনেছিলেন বাবরির মাথায় শাবল চালিয়ে, সেগুলো পানিপথে শিবসেনার স্থানীয় অফিসে সাজিয়ে রাখা হয়।

কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই রে রে করে ওঠেন বলবীরের বাবা দৌলতরাম। বলবীরের কথায়, ‘‘বাবা আমাকে বললেন, হয় তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। তো আমিই বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার স্ত্রীও বেরিয়ে এলো না। থেকে গেল বাড়িতেই।’’

ওই সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন বলবীর। জানিয়েছেন, লম্বা দাড়িওলা লোক দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতেন তখন। বেশ কিছু দিন পর বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গেছেন। তিনি বাবরি ভাঙায় যে দুঃখ পেয়েছিলেন বাবা, তাতেই নাকি তার মৃত্যু হয়েছে।

এর পর পুরনো বন্ধু যোগেন্দ্রের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরো মুষড়ে পড়েন বলবীর। জানতে পারেন, যোগেন্দ্র মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। যোগেন্দ্র নাকি তখন বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রর মনে হয়েছিল পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র।

এর পরই আর দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে মৌলানা কালিম সিদ্দিকির কাছে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন বলবীর। হয়ে যান মোহাম্মদ আমির।

‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে কী কী করতে চান বলবীর সিংহ ওরফে মোহাম্মদ আমির? বলবীরের কথায়, ‘‘কম করে ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদকে মেরামত করতে চাই।’’

বলবীরের দাবি, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭, এই ২৪ বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে মেওয়াটে বেশ কিছু ভেঙে পড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলোর মেরামত করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের কাছে মেন্ডুর মসজিদও নাকি সারিয়েছেন বলবীরই। সেই কাজে মুসলিমরাই তাকে এগিয়ে এসে সাহায্য করেছেন, দাবি বলবীরের।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা