Jute-Sipinurs-2দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের পাট খাতের তালিকাভুক্ত জুট স্পিনার্সের উৎপাদন ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ থাকলেও লাগামহীন বাড়ছে শেয়ার দর। কোম্পানিটির অস্বাভাবিক শেয়ারদর বাড়ায় বুধবার বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কোম্পানির অস্বাভাবিক শেয়ার দর বাড়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে জুট স্পিনার্সের। উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বাড়ায় আমরা অবাক। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আরো বলেছে, এ অবস্থায় কোম্পানিটির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কোনো কারণ বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তাদের কাছে নেই।

জানা যায়, ২০১৩ সালের পর থেকে টানা লোকসানে রয়েছে জুট স্পিনার্স। ওই বছর (২০১৩ সাল) কোম্পানিটির কর পরবর্তী লোকসান হয়েছিল ৮ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৩০ জুন ২০১৬ সাল শেষে কোম্পানিটির কর পরবর্তী লোকসান হয়েছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

jut২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে টানা লোকসানে থাকলেও ওই সময় কোম্পানিটির উৎপাদন অব্যাহত ছিল। কিন্তু লোকসানের মাত্রা বাড়ায় পহেলা জুলাই ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় জুট স্পিনার্স কর্তৃপক্ষ।

তবে পুঁজিবাজারে লেনদেনেও আগের চেয়ে ধীর গতিতে বাড়ছে। এ সুযোগে কিছু কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। অভিযোগ পেলে স্টক এক্সচেঞ্জ দায়সারা গোছের একটি কারণ দর্শানো নোটিস দেয়। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মেলে না সদুত্তর। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্চের (ডিএসই) পক্ষ থেকে শোকজ নোটিশ পাওয়ার পর থেকেও অপ্রতিরোধ্য ছিল জুট স্পিনার্স। তবে পাট খাতের জুন স্পিনার্স   কোম্পানিটি জানিয়েছে, তাদের কারখানা ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।

page 1 (3)ওই বার্তায় কোম্পানিটি জানিয়েছে, উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্বেও শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখে আমরা অবাক হই। কোম্পানিটি আরো জানায়, কোম্পানির কারখানায় উৎপাদনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ অবস্থায় কোম্পানিটির শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কোনো কারণ বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তাদের কাছে নেই।

ডিএসই’র সূত্র মতে, দুপুর ১২টার দিকে ৯৪ হাজার ৮০৯টি শেয়ার ১২৬ টাকায় শেয়ার কেনার আবেদন থাকলেও বিক্রেতার ঘর শূণ্য ছিল। আলোচিত সময়ে কোম্পানিটি ৯ হাজার ৪৬৯টি শেয়ার ১৯ বার হাতবদল হয়। যার বাজার দর  ১১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। কোম্পানির শেয়ার দর সর্বশেষ ৯.৯৪ শতাংশ বেড়ে ১২৬ টাকায় লেনদেন হয়।

এদিকে গত কয়েক কার্যদিবস ধরে টানা বাড়ছে কোম্পানির শেয়ার দর। এমনকি  সোমবার কোম্পানির শেয়ার দর হল্টেড হয়ে সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করে। যা বিনিয়োগকারীর কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের গতকালও শেয়ার বিষয়ে সর্তক করে কোম্পানি জানায়, কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি সংক্রান্ত এমন কোনো অপ্রকাশিত তথ্য নেই যা শেয়ারের দামে প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে জুট স্পিনার্স নিয়ে বাজারে গুজব চলছে কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। আর এ গুজবের সাথে কোম্পানির লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ সুত্রে জানা যায়। কোম্পানির অভ্যন্তরেই কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট জুয়াড়িদের সঙ্গে আঁতাত করে এর শেয়ার দর বাড়ানো হয়েছে বলে বাজারে গুঞ্জন উঠেছে।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্ত করলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো গোপন খবর স্টক এক্সচেঞ্জ বা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করাকে সুবিধাভোগী প্রকৃত গ্রাহক (ইনসাইডার টার্নওভার নিট ক্লায়েন্ট) বলে।

যদিও তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে প্রচার করে তারা সিংহভাগ শেয়ার কেনে।

তারপর তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়। তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে, যা আইনত সম্পূর্ণ অবৈধ।

এ প্রসঙ্গে কোম্পানি সচিব সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। উল্লেখ্য, পারিবারিক দ্বন্ধ ডুবছে পাট খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি জুট স্পিনার্স লিমিটেড। দুই সহোদর পরিচালক মোহম্মদ শামস-উল হুদা ও মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার মধ্যে দ্বন্ধ চলছে।

টানা চার বছর ধরে লোকসান, চলতি মূলধন সংকট, বিদ্যুৎ ও পাটের দাম বকেয়া, বিসিকের কাছে দেনা, শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতা— সবমিলে দিন দিন আরো নাজুক হচ্ছে কোম্পানির অবস্থা।

এ অবস্থায় কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা জানিয়েছে নিরীক্ষক। অন্যদিকে টানা কারখানা বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক।

কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ জুট অ্যান্ড টুয়াইন মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামস-উল হকের উদ্যোগে জুট স্পিনার্স প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম পাটকল।

একসময় কোম্পানিটির বেশ সুনাম ছিল। এমনকি এটি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পাটকলের পুরস্কারও পেয়েছিল। তাছাড়া আইএসও সনদপ্রাপ্ত কোম্পানিটির তৈরি করা পণ্য তুরস্ক, মিসর, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, স্পেন, চীন, ভারত ও উরুগুয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। মূল উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শামস-উল হক ২০১০ সালে মারা যাওয়ার পরে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে তার দুই ছেলে শামস-উল হুদা ও মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দেয়।

এর ফলে কোম্পানির আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণসহ পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ক্রমান্বয়ে পণ্যের বাজার হারানোর পাশাপাশি দুর্বল হতে থাকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও।