jammatদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলের ঢাকা উত্তরের আমির ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে প্রার্থী করা হয়েছে। বুধবার (৩ জানুয়ারি) বিকালে ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ জানানো হয় দলের এই সিদ্ধান্ত। এর পেছনে ঠিক কী কারণ আছে তা খতিয়ে দেখতে জামায়াত, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের অন্তত আট জন জ্যেষ্ঠ দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলেছে দেশ প্রতিক্ষণ।

এমনিতে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন স্থগিত। পাশাপাশি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে আলোচনার আগেই ঢাকা উত্তরে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো দলটি।

সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, জামায়াত প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় অনেকটাই চমকে গেছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট। দলটির আকস্মিক এই সিদ্ধান্তের পর চিন্তায় পড়েছে বিএনপিও। জামায়াতের প্রার্থীতা দেওয়ার কারণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিএনপির শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতারা।

বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আপাতত জামায়াতের অ্যাক্টিভিটি পর্যবেক্ষণ করবেন তারা। পরবর্তী সময়ে জোটের বৈঠকে অন্যান্য শরিক দলগুলোর মাধ্যমে আলোচনায় আনা হবে বিষয়টি।

যদিও ২০ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতা বলছেন— জামায়াত কেবল উত্তর সিটির উপ-নির্বাচন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দর কষাকষি করতেই আগাম প্রার্থীতা ঘোষণা করলো। যদিও তফসিল ঘোষণার আগে জোটকে আলোচনার কোনও সুযোগ না দিয়ে একক প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক।

আবার কোনও-কোনও নেতা জামায়াত ও বিএনপি উভয়কেই দাম্ভিক বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের ভাষ্য, জামায়াত ব্যবহারে দাম্ভিকতার পরিচয় দিয়ে আসছে। আর বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সবশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে জোটের কোনও নেতাকেই কিছু জানায়নি তারা।

জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার খবরে অনেকটাই বিস্মিত জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘খবরটা জেনে কিছুটা অবাকই লাগছে। জামায়াত তো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। আর আমার মনে হয়, দর কষাকষি করতেই জামায়াতের এরকম অবস্থান নেওয়া। এটা করতেই হয়তো জামায়াত প্রার্থী দিলো। বাকিটা আমার জানা নেই।’

২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ একটি দলের চেয়ারম্যান বললেন, ‘জামায়াত ভালো করেই জানে, তাদের প্রার্থী একা-একা কোনোদিন মেয়র হতে পারবে না। এটা মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে লড়াই। আমার মনে হয়, অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে দল হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান দেখাতেই প্রার্থী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।’

খেলাফত মজলিসের একজন নেতার ভাষ্য, ‘তফসিল ঘোষণা হবে, আমরা বসবো, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করে দিলো। আমি ঠিক জানি না, এটা কেন করলো তারা।’

জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে জানেন না বলে মন্তব্য করলেও এই দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষ্য, ‘আমি জেনেছি। অানুষ্ঠানিকভাবে জানি না জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে কিনা।’

জামায়াতের প্রার্থীর কারণে বিএনপি’র ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তাবিথ আউয়াল বলেছেন, ‘আমি নীতিগতভাবে মনে করি, যত বেশি প্রার্থী হবে তত ভালো। তাহলেই না নির্বাচন বলা যাবে। আর অফিসিয়ালি বলার আগে এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করতে চাই না।’

জামায়াতের আগেভাগে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে কথা হয় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ একজন নেতার সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে এখনও নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। জোটের ওপর কোনও ধরনের প্রভাব পড়বে কিনা তা তফসিল ঘোষণার পর বোঝা যাবে।’

এ প্রসঙ্গে জোটের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার আগে প্রার্থী ঘোষণা হতেই পারে। আলাদাভাবে কোনও দল চাইলে তা করতেই পারে। কিন্তু জোটের প্রার্থী কে হবেন, তা তফসিল ঘোষণার পরই বোঝা যাবে।’

জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রথমত দলের জনশক্তিকে কাজে লাগানো ও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই ডিএনসিসি’তে মেয়র প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রায় ২৫ লাখ ভোটারের মধ্যে দলীয় ভোটারের সংখ্যা অনেক কম হলেও দলীয় ভাবমূর্তি কেমন তা দেখতে চায় দলটির নীতিনির্ধাকরা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জোটবদ্ধতার নজির একেবারে কম। এ কারণেও দলটির শীর্ষনেতারা মনে করেছেন, মেয়র প্রার্থীতা দেওয়া উচিত।

জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রভাবশালী একজন সদস্য ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রার্থী জিতবে নাকি হারবে তা বিবেচ্য নয়। বিএনপি তো জিজ্ঞাসাও করে না প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে। আমরা মনে করি, জামায়াতের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। তাই মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হলো।’

১৯৯৪ সালেও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। এখন তিনি কারাগারে।

দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাভুটি হয়। শাখার নেতাকর্মীরা ভোট দিয়ে কয়েকজনের নাম কেন্দ্রে পাঠানোর পর ভোটপ্রাপ্তির ফলে মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন এগিয়ে থাকেন। এর সূত্র ধরে বুধবার বিকালে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ।

ওই সূত্রটি আরও জানায়, নির্বাচনি প্রচারণা করা হবে অনানুষ্ঠানিকভাবেই। দলের প্রার্থীর তথ্য দেওয়া হবে গণমাধ্যমে। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সংবাদ সম্মেলনের সুযোগ না থাকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে কিনা তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ভারপ্রাপ্ত আমিরের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের প্রার্থীর প্রচার হয়ে যাবে।’

অনেকটাই গোপনে থেকে কতটা নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে, এমন প্রশ্নে ঢাকা মহানগর জামায়াতের একজন নেতা  বলেছেন, ‘তুরস্কে একে পার্টিও ভেতরে-ভেতরে কাজ করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। জামায়াত প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সমানভাবেই কাজ করে। আমাদের প্রতি মানুষ আগের চেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল বলে মনে করি।’

জামায়াতের সূত্র জানায়— দ্রুতই নির্বাচন পরিচালনা ও গণসংযোগসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন ও পোস্টার করা হবে। যতটা সম্ভব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে গণসংযোগের প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে দাবি ওই সূত্রের।

২০১৫ সালের নির্বাচনে ২২টি ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল জামায়াত। তাদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছিল। সিলেটেও জোটের সঙ্গে আলোচনার আগেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহানগর আমির অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রচারণা চালাচ্ছেন।

একটি সূত্র জানায়, মনোনীত মেয়র প্রার্থী মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। ছাত্র রাজনীতি শেষ করে জামায়াতের রমনা থানার দায়িত্বশীল হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এই থানার সভাপতি, এরপর অবিভক্ত ঢাকা মহানগর কমিটির সহকারী সেক্রেটারি পদে দেখা গেছে তাকে। পরে গত বছরের শুরুর দিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ হলে তিনি উত্তরের আমির নির্বাচিত হন। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে।

জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রটির ভাষ্য— ‘মেয়র প্রার্থী দেওয়া হলো, এখন বিএনপি আলোচনা করবে। এমনকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা হলে মেয়র বাদ গেলেও ১৮টি নতুন ওয়ার্ডে নির্বাচন হবে। সেগুলোতে কমিশনার চাওয়া হবে বিএনপির কাছে। সেক্ষেত্রে ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে কমপক্ষে ৮টি ওয়ার্ডে জোটের সমর্থন চাওয়া হবে।’

বর্তমানে জামায়াতের মনোনীত দু’জন ঢাকা মহানগর উত্তরে মহিলা নেত্রী কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্বরত বলে জানা গেছে। সূত্রের ভাষ্য— নতুনভাবে ঢাকা উত্তর সিটিতে আরও ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে। এগুলোতে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে দর কষাকষি করতে চায় জামায়াত। এ বিষয়টি জোটের সঙ্গে আলোচনার পর দেখা যাবে।