hasinaদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের চার বছর পূর্তি আজ। এর মধ্য দিয়ে রেকর্ডও গড়লেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার একটানা দুই মেয়াদের শাসনামলের নয় বছর পূর্ণ হলো। এর আগে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন আট বছর ২৫২ দিন।

বিগত নয় বছরে শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিতেই নয়, বিশ্ব রাজনীতির বাঁকে বাঁকে ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সতর্ক ও দৃপ্ত পদচারণা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

এই চার বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের সড়ক, মহাসড়ক, উড়াল সড়ক থেকে শুরু করে পদ্মা সেতুর মতো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প নিজ অর্থায়নে শুরু করার মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার জানান দিয়েছে এ সরকার।

শুধু বাজেট বৃদ্ধি নয়, মাথাপিছু আয়, রপ্তানি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্ত ও মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের লাগাতার অবরোধের কারণে প্রথম বছরে কিছুটা বেগ পেতে হলেও পরবর্তী তিন বছর অনেকটা নির্ঝঞ্ঝাটভাবে পার করেছে।

এরপরও ঘরে-বাইরে নানা সমস্যা সমাধান করে এগিয়ে চলা এ সরকারকে গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে সরকার ও নিজের ভারমূর্তি আরো উজ্জ্বল করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য তাকে মাদার অব

হিউম্যানিটি পদবিতে অভিহিতও করা হয়েছে। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্যে আর উন্নয়নের পতাকা উড়িয়েই আজ ৯ বছর পূর্ণ করল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার।

পঞ্চম বর্ষে এসে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিজ দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান এবং বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবিলা করে আগামী নির্বাচনে নিজেদের জনপ্রিয় হিসেবে প্রমাণ করাও অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া জঙ্গিবাদ ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চাপ উপেক্ষা করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিজস্ব অর্থায়নে এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ শুরু হয়। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ দ্বিতল সেতুটি নির্মাণ নিয়ে শুরুতে অনেকেই উপহাস ও এর কাজ সম্পন্ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে দুটি বসানো হয়েছে।

চলতি বছর ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ এ সেতুর মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে খুব সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। শুধু যোগাযোগেই নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে সেতুটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। সেতুটি নির্মাণ হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ওই অঞ্চলের মানুষের আয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে। আর ৭ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে।

এ সরকারের আরেকটি সফলতা হচ্ছে ঢাকার অভ্যন্তরে সর্ববৃহৎ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ করা। মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারটি গত বছর অক্টোবরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। চার লেনের এ ফ্লাইওভারে ওঠানামার জন্য ১৫টি র‌্যাম্প রয়েছে। তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামটর, মালিবাগ,

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এবং শান্তিনগর মোড়ে ওঠানামা করার ব্যবস্থা রয়েছে। এটি রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। প্রায় ৯ কিলোমিটার লম্বা ফ্লাইওভারটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ সরকারের আরো একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হচ্ছে নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ। গত বছর ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন ও নারীদের ধর্ষণ শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি বাস্তুহারা করতে অগ্নিকা- ও হত্যাযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও।

এ অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। আগের ৪ লাখের সঙ্গে নতুন প্রায় ৬ লাখ যুক্ত হয় বাংলাদেশে। প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে দেশে আশ্রয় দিয়ে চরম মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এ সরকার। শেখ হাসিনার সাহসী এ পদক্ষেপে বিশ্ব প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। সমস্যা সমাধানে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। শেখ হাসিনা নিজেও ছুটে যান অসহায় রোহিঙ্গাদের শিবিরে।

পাশাপাশি বিশ্বনেতাদের মধ্যে তুরস্কের ফার্স্টলেডি ও জর্ডানের রানী ছাড়াও জার্মানি, চীন, জাপান এবং সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এছাড়া সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। এই গ্রুপের কাজ হবে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন শুরু করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতিকে গত বছর অনেক বৈরী আচরণ করতে দেখা গেছে।

পাহাড়ি ঢলে অসময়ে হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে যায়। সাধারণ কৃষকের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার তাদের পাশে দাঁড়ায়। এরপরই দেখা দেয় অকাল বন্যা। উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলা প্লাবিত হয় এ বন্যায়। সরকার বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এর মধ্যে ১০ টাকা কেজিতে চাল দিয়ে বানভাসি মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকার। গত বছর বন্যার পাশাপাশি শীতও সরকারকে কিছুটা সমস্যায় ফেলেছে। এরই মধ্যে গত ৫০ বছরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল উত্তরাঞ্চলের তেঁতুলিয়ায়। দেশজুড়েই তীব্র শীতে কষ্ট করছেন মানুষ। কম্বল ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায় সরকার।

গত বছর সরকার ও দেশের জন্য বড় অর্জন হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ-এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কোর একটি উপদেষ্টা কমিটি এ স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা গত বছর ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরকারের সফলতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৭ সালের সফলতার সঙ্গে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সারা বছর। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে গত বছরও প্রাণ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সদস্য। সতর্ক অবস্থান ও দফায় দফায় অভিযানের ফলে জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থানে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় অবস্থায় রয়েছে।

ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ এমপি ও তৃণমূল নেতাদের কোন্দল এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের খবরে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে সরকারকে। এমপি ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের অপকর্মের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে দেখা গেছে। এছাড়া নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রাণ দিতে হয়েছে দলের ভেতরের অনেককেই। এজন্য দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন দলীয় নেতাকর্মী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে।

তিনি বলে দিয়েছেন, ‘মুখ দেখে নয়, কাজ ও জনপ্রিয়তার বিচারে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে।’ এরই মধ্যে সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। ২৬ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে সফর শুরু করবেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান প্রমাণ করে শেখ হাসিনা অনেক বড় মাপের নেত্রী। সম্প্রতি পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস, বিশ্বের পাঁচ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এ পাঁচ সরকারপ্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর আগে টাইম ম্যাগাজিনের বিবেচনায় বিশ্বের প্রভাবশালী ১০ নারীনেত্রীর একজন মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সবসময় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার কাজ সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। আমার রাজনীতি সাধারণ মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়।

পঞ্চম বর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান চ্যালেঞ্জই হচ্ছে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজ দলের চেইন অব কমান্ড গড়ে তোলা। দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করে দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের যে কোনো ষড়যন্ত্র ও আন্দোলন মোকাবিলা করাও বড় চ্যালেঞ্জ।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আবারো বিজয়ী হয়ে অতীতের মতো শক্ত হাতেই জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র দমন করে সুখী-সমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায় এ সরকার।