DSE-CSE-logoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক হলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না সেদিকে নজরদারি নেই দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর। অথচ বিনিয়োগকারীদের জন্য অপরিহার্য তথ্যগুলো কোম্পানিতে থাকার কথা। আইন আছে কার্যকর নেই এমন ধারায় চলছে পুঁজিবাজার।

বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগে ঝুঁকি এড়াতে কোম্পানি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য যথাসময়ে নির্ভুলভাবে জানতে পারায় বাজে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। এর দায় বাজার পরিচালনাকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

বিষয়টি নিয়ে বাজার পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের বক্তব্যে সমন্বয়হীনতা ও পরস্পরের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা দেখা যায়।

page 1ডিএসইতে তালিকাভুক্তির বিধিমালা অনুযায়ী, কোম্পানির ‘অফিসিয়াল’ ওয়েবসাইটে বার্ষিক ও প্রান্তিক আর্থিক বিবরণী, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ-ব্যবস্থাপনা কমিটি, ব্যবসাসহ সার্বিক কর্মকান্ড, পরিচালকদের শেয়ারধারণের পরিমাণ, পরিচালকের প্রতিবেদন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও যোগাযোগের ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। কোম্পানির সংখ্যার দিক দিয়ে ডিএসইতে সবচেয়ে বড় খাত বস্ত্র শিল্প। দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখাতের অধিকাংশ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে ওই নিয়ম না মানলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর করপোরেট গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক এম বাকী খলিলী বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, উৎপাদনে নেই অথচ বাজারে লেনদেনে আছে এমন কোম্পানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। স্টক এক্সচেঞ্জের উচিত এই ডিসক্লোজারটা নিশ্চিত করা, তাহলে এই যে মার্কেট ম্যানিপুলেশন হচ্ছে তা আর হবে না। স্টক এক্সচেঞ্জ শুধু শেয়ার কেনাবেচার প্লাটফরম হওয়া উচিত না।

বিনিয়োগকারীদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাও স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব।” ২০১০ সালে শেয়ার নিয়ে ব্যাপক কারসাজিসহ নানা অনিয়মের মধ্যে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধস হলে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যায়।

ওই সময় কয়েক মাস ধরে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ চলে, অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল হয়। এরপর বাজার সংস্কারে ডিমিউচুয়ালাইজেশন ও তালিকাভুক্তি বিধিমালাসহ একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এর পর পুঁজিবাজারে তুলনামূলক নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য যেসব বিষয় বিবেচনা করতে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেয় তার মধ্যে প্রধান হলো: মৌল ভিত্তির কোম্পানি বাছাই করা।

মৌল ভিত্তির কোম্পানি বাছাইয়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, সম্পদের পরিমাণ ও যথাযথ ব্যবহার, নিয়মিত লভ্যাংশ ও লভ্যাংশের হার, নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা এবং কোম্পানির কাছে শেয়ারহোল্ডারদের মতামতের গুরুত্ব, শেয়ারপ্রতি মুনাফা, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ, ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি, সঠিক সময়ে সব মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ এবং সব আইনকানুন ও বিধি মেনে কোম্পানি পরিচালনার মতো বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের দেখতে হবে।

বিধি অনুযায়ী, কোম্পানির ওয়েবসাইটে এসব তথ্য প্রকাশ করা না হলে বিনিয়োগকারীরাও তা জানতে পারবেন না। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধসের সময় ডিএসইর সামনে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধসের সময় ডিএসইর সামনে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বস্ত্র খাতের ৪৮টি কোম্পানির প্রায় সবগুলো তালিকাভুক্তির বিধিমালার ৪৪ অনুচ্ছেদের ওই বিশেষ বিধিটি লঙ্ঘন করছে। শুধুমাত্র অ্যাপেক্স স্পিনিং অ্যান্ড নিটিং মিলস, ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস ও মেট্রো স্পিনিং মিলস তাদের ওয়েবসাইটে বিধিমালা অনুযায়ী সবধরণের তথ্য প্রকাশ করেছে। বাকি ৪৫টি কোম্পানির ওয়েবসাইটে সব তথ্য নেই।

বিধি অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির ওয়েবসাইটের লিংক স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এবং তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদনের পর থেকেই ওয়েবসাইট সচল থাকবে। যেখানে বিধিতে উল্লিখিত সব তথ্য হালনাগাদ রাখা হবে। কিন্তু বস্ত্র খাতের আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ও দেশ গার্মেন্টসের ওয়েবসাইটে প্রবেশই করা যায়নি।

এবিষয়ে জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে দেশ গার্মেন্টসের সিনিয়র ম্যানেজার আবু সাইখ বলেন, “ওয়েবসাইট ডেভেলপারের কাছে দেওয়ায়, ওয়েবসাইট উন্নতকরণের কাজ চলায় সাময়িকভাবে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে অসুবিধা হচ্ছে।”
কতদিন ধরে এই সমস্যা চলছে এবং কবে নাগাদ সমাধান হবে জানতে চাইলে সোমবার ‘অফিস আওয়ারের মধ্যে’ জানানোর প্রতিশ্রæতি দেন তিনি। এদিকে কোম্পানির ওয়েবসাইটে পরিচালনা পর্ষদ/ট্রাস্টি/শীর্ষ-ব্যবস্থাপনা কমিটি/ইস্যুকারক ব্যক্তির ছবিসহ প্রোফাইল থাকার কথা থাকলেও ১১টি কোম্পানি এই বিধি যথাযথভাবে মানছে না।

এগুলো হল: অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, সিএমসি কামাল টেক্সটাইল মিলস, দি ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং, ফ্যামিলিটেক্স (বিডি), ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং, এইচ আর টেক্সটাইল, নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার, স্কয়ার টেক্সটাইলস, জাহিন স্পিনিং ও জাহিন ইন্ডাস্ট্রিজ।

বেশ কয়েকটিতে পরিচালনা পর্ষদ কিংবা শীর্ষ-ব্যবস্থাপনা কমিটির ছবিযুক্ত প্রোফাইল নেই। কোথাও ওয়েবসাইটে শুধুমাত্র পরিচালনা পর্ষদ বা শীর্ষ-ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রোফাইল অথবা শুধুমাত্র নাম প্রকাশ করা হয়েছে। কোম্পানির ওয়েবসাইটে অন্তত সর্বশেষ ছয়টি প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী এবং তালিকাভুক্তির আগের পাঁচ বছরসহ প্রতিবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী প্রকাশের বিধি মানার ক্ষেত্রেও কোম্পানিগুলোর গরজ নেই।

জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনসের ওয়েবসাইটে কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী দেওয়া নেই। কোম্পানিটি ওয়েবসাইট সংক্রান্ত বিধির বেশিরভাগই অনুসরণ করছে না। ফ্যামিলিটেক্স বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে কোনো প্রান্তিক আর্থিক বিবরণী নেই। রিজেন্ট টেক্সটাইলসের ওয়েবসাইটে শুধু একটি প্রান্তিক আর্থিক বিবরণী পাওয়া গেছে।

পরিচালকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি আল-হাজ টেক্সটাইল মিলস, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, দি ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং, ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং, এনভয় টেক্সটাইলস, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং, মালেক স্পিনিং মিলস, মতিন স্পিনিং ও সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ওয়েবসাইটে।

স্কয়ার টেক্সটাইলের ওয়েবসাইটে আর্থিক বিবরণী ও যোগাযোগের ঠিকানা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই দি ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ও নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটারের ওয়েবসাইটে। অনেক কোম্পানির ওয়েবসাইটে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য থাকলেও সেগুলো সাম্প্রতিক নয়।

বিধিলঙ্ঘন করা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র সাইফুর বলেন, কমিশনের সভায় আলোচনা করে এই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কোম্পানিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিতে শিথিলতার বিষয়ে তার বক্তব্য, “যেহেতু বিধিনিষেধ প্রয়োগ করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তাই এটা দেখার দায়িত্ব প্রথমত তাদেরই। তারা কোনো ‘ভায়োলেশন’ পেলে সেটা আমাদের জানাবে। আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।”

অন্যদিকে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান বলছেন, ‘নিজস্ব উপায়ে’ বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষা ও দক্ষতার সঙ্গে বাজার পরিচালনা দেখভালের’ গুরুদায়িত্ব রয়েছে বিএসইসির ওপর।

তিনি বলেন, কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যগুলো ডিএসই পর্যবেক্ষণ করে থাকে। আইনের লঙ্ঘন হলে ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী দন্ড দেওয়া হয়। তবে বাজারে কারসাজি রোধে বিএসইসির দায়িত্বই প্রধান বলে মনে করেন করপোরেট গভর্ন্যান্স ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বাকী। তাদের (বিএসইসি) নিজস্ব সফটওয়্যার আছে সেগুলোর মাধ্যমে দেখবে প্রাইসের ওঠানামা, কোন কোম্পানি ভায়োলেট করছে বা করছে না সেটা দেখার দায়িত্ব তাদেরও।”