dorpoton lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে স্মরনকালের দরপতনের ধ্বস কাটিয়ে গত ৭ বছরেও স্থিতিশীল হয়নি। বিনিয়োগকারীরা বারবার বাজার নিয়ে আশার আলো দেখলেও তাদের সেই আশা স্থায়ী হয়নি। বারবার নতুন করে বিনিয়োগ করেও লোকসানের প্রহর গুনছেন। উল্টো ফেসবুক, মোবাইলসহ বিভিন্নভাবে বাজারে গুজব ছড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুঁজি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। কারসাজির মাধ্যমে উধাও হয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের শত শত কোটি টাকার পুঁজি।

গেল ৫ কার্যদিবসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজারমূলধন কমেছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চিত্রও প্রায় একই। মাত্র এ কয়েকদিনেই অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। এর মধ্যে রোববার একদিনেই বাজারমূলধন কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। গত চার বছরের মধ্যে এমন ঘটনা নজিরবিহীন।

এদিকে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির কোন মিল নেই। সরকারের শেষ বছরে বিনিয়োগকারীদের আশা ছিল পুঁজিবাজার আরও চাঙ্গা হবে। বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু এখন উল্টো তারা শঙ্কিত। প্রতিদিনই রক্তক্ষরণ হচ্ছে পুঁজিবাজারে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৪ বছরে বাজারে এভাবে টানা দরপতন দেখা যায়নি। এর আগে এই সরকারের মেয়াদকালে দু’বার পুঁজিবাজারে বিপর্যয় ঘটেছে। বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস ছিল অন্তত সরকারের শেষ সময়ে বাজারে গতি আসবে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও চাঙ্গা হবে।

কিন্তু গত সপ্তাহে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করেই বাজারে ছন্দপতন ঘটে, যা ধারাবাহিকভাবে চলছে। এখন আবার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গুজব নির্ভর আতঙ্কে ভয় পেয়ে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি দিচ্ছে। আবার অনেকে এ পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকেও দায়ী করছেন।

এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যথাযথ তদারকি না থাকা এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেয়ার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ৮ ফেব্রæয়ারি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা একটি মামলার রায়ের কথা রয়েছে। রায়ে খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে অস্থির হয়ে উঠবে দেশ- এমন গুজব রয়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোয়। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে দেখা গেছে, এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, আতঙ্কিত না হয়ে এ সুযোগে কম দামে শেয়ার কিনলে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন। বিশেষ করে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার কম দামে কেনার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, কারসাজি করেই এভাবে বাজার খারাপের দিকে নেয়া হচ্ছে। অতীতে অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। এভাবে কম দামে শেয়ার কিনে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে সুযোগসন্ধানীরা।

এ বিষয় জানতে চাইলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, রাজনৈতিক কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ৮ ফেব্রæয়ারি বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে- এ আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত। এছাড়া এখন বাজারে অস্থিরতার অন্য কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের ভাষায় এটাকে বলা হয়, আউট সাইট শক (বাইরে থেকে অপ্রত্যাশিত কোনো দুর্যোগ)। ফলে ৮ তারিখের আগে বাজার স্থিতিশীল করার জন্য খুব বেশি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই। ওইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মূল্যকে একসঙ্গে বাজার মূলধন বলা হয়। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনের বিষয়টি বাজার মূলধন থেকেই সহজে মূল্যায়ন করা হয়। ২৯ জানুয়ারি ডিএসইর বাজারমূলধন ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ৫ কার্যদিবসে তা কমে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে বাজারমূলধন কমেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে মূল্যসূচক কমেছে ৩০৭ পয়েন্ট।

প্রায় চার মাস পর ডিএসইর বাজারমূলধন কমে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। দিনশেষে সোমবার ডিএসইর সূচক ছিল ৫ হাজার ৮৬৯ পয়েন্ট। এরপর সোমবার সকালে ১১৬ পয়েন্ট কমে যায় সূচক। তবে ওইদিন আইসিবিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাপোর্টে তা আবার টেনে তোলা হয়েছে। ফলে শেষ দিনশেষে সূচক কমেছে ১৮ পয়েন্ট। বড় বড় হাউসকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার বিক্রি করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এরপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ রয়েছে। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবেই বাজারে কিছুটা তারল্য সংকট রয়েছে। কারণ গত বছরের জানুয়ারিতে ডিএসইর গড় লেনদেন ছিল ১ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ৪৩৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

এ বিষয় সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে আতঙ্ক রয়েছে ৮ ফেব্রæয়ারি কী হবে। বিনিয়োগকারীদের বিবেচনা হল ওই রায়ে বড় কিছু হলে শান্তিশৃখলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। শান্তি বিনষ্ট হবে। তিনি বলেন, এ আতঙ্ক অযৌক্তিক এবং অহেতুক। কারণ ওইদিন বড় কিছু হলেও বর্তমান বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির কোনো কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, এর আগে মুদ্রানীতিতে নেতিবাচক কিছু আসতে পারে, ওই আতঙ্ক ছিল। কিন্তু আতঙ্ক কেটে গেছে। কারণ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। এদিকে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষ ব্রোকারদের সঙ্গে রোববার জরুরি বৈঠক করে বিএমবিএ ও ডিবিএ নেতারা। বৈঠক শেষে ডিবিএ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে শীর্ষ ৩০ ব্রোকারেজ প্রতিনিধির বক্তব্য শুনেছি।

তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বলা যায়, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিছক গুজবের কারণে হয়েছে। পাশাপাশি বাজার খারাপ হলে প্রাতিষ্ঠানিক বড় বিনিয়োগকারীদের থেকে যে সাপোর্ট পাওয়া যেত, তা এবার পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, অতীতে বহু রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে অনেক গুজবের ঘটনা ঘটেছে।

তবে এবারের ঘটনা একটু বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, বাজারে সাপোর্ট দিতে আইসিবিকে বরাবরই শক্তিশালী অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে খোদ আইসিবিকেই যদি দুর্বল করে রাখা হয়, তাতে সাপোর্ট লেবেলও দুর্বল হয়ে যাবে। তার মতে, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে বাজার ভালো হবে।

ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি কোনোভাবে কাম্য নয়। শুধু খালেদা জিয়ার একটি রায়কে কেন্দ্র করে এ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে না। এর সঙ্গে অন্য কোনো কারণ আছে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না। অবশ্যই মন্ত্রণালয়কে দায় নিতে হবে। ডিএসইর এই আলোচিত-সমালোচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপ পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বিশেষ করে প্রতিবছর মুদ্রানীতি এলেই বাজারে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। কয়েক বছর ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় পুঁজিবাজার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে সব দেশেই মুদ্রাবাজারের সঙ্গে পুঁজিবাজারকে সমন্বয় করে পলিসি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশে যা ব্যতিক্রম।