dorpoton lagoবিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট খেলছে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো বাজার। বিষয়টি সরকারের গোচরে থাকলেও এই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার একের পর এক উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারিও ছিল।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কোনো অসাধু চক্র পুঁজিবাজার নিয়ে আবার কারসাজিতে মেতে উঠতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ব্রোকারেজ হাউজের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ১৯৯৬ কিংবা ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন কোনোভাবেই না ঘটে সে দিকে নজর রাখতে বলা হয়।

সম্প্রতি প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক ৪ ফেব্রæয়ারি হঠাৎ করে ১৩৩ পয়েন্ট কমে যায়, যা ছিল গত তিন বছরের সর্বোচ্চ দরপতন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনার দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ শীর্ষ ব্রোকারেজ মালিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে।

পরে সংবাদ সম্মেলন করে কাউকে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি বলা হয়, বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের উচ্চ মহলকে পুঁজিবাজারে আবার কারসাজি হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সপ্তাহের শেষদিকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন।

এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারেও সম্প্রতি অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ৬ ফেব্রæয়ারি মার্কিন পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। সেদিন দেশটির প্রধান পুঁজিবাজারের সূচক হঠাৎ করেই ১৬০০ পয়েন্ট কমে যায়। এতে সেখানকার বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বৈশ্বিক প্রভাবও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাবে সৃষ্টিতে পুঁজিবাজার কারসাজির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা বলেছেন, সরকারের প্রতিটি সংস্থাকে সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেন কোনো কোম্পানির শেয়ার অতিমূল্যায়িত না হয়। এতে যেন কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে। এমনকি প্রযুুক্তিগত দিকগুলোও নজরে রাখতে বলা হয়েছে।

page 1 (25)অন্যদিকে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন গত ১৪ ফেব্রæয়ারি এক কর্মশালায় বলেন, পুঁজিবাজারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হবে না। বিনিয়োগকারী এবং স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থে যা যা করা দরকার তার সবই করা হবে।

বিএসইসি বিগত কয়েক বছরে বিনিয়োগকারী এবং স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক আইন প্রণয়ন করেছে, পাশাপাশি অনেক আইনের পরিবর্তন এনেছে। যে কারণে পুঁজিবাজার এখন স্থিতিশীল পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, ডিএসই কর্তৃপক্ষ পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে চার দফা সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবের মধ্যে ছিল কস্ট প্রাইসে এক্সপোজার বিবেচনা, বন্ডে বিনিয়োগ এক্সপোজারের বাইরে দেখা, হাউসগুলোর নতুন শাখা খোলার অনুমতি, লেনদেন ডেটার গোপনীয়তা রক্ষা। পাশাপাশি আইসিবিকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব সুপারিশ দ্রæত বাস্তবায়নেরও নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

পাশাপাশি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বা এক্সপোজারের সীমা পুনর্বিন্যাস বা রিভিউ করা। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সিএসই। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছেও চিঠি পাঠানো হয়।

অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর থেকে পুঁজিবাজার পতনের ধাক্কায় রয়েছে। বাজারের এ পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যে শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউস বৈঠক করেছে। সেখানে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য এক্সপোজারের বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

কারণ পুঁজিবাজারে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারমূল্য হিসাবে ধরা হয়। এতে শেয়ারের দর বেড়ে গেলেই এক্সপোজারের সীমা বেড়ে যায়। তখন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিক্রি করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। তাই এক্সপোজারের আওতা থেকে বন্ড, ডিবেঞ্চার, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাইরে রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের এককভাবে দুই শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নির্দেশনা রয়েছে। ২ শতাংশ শেয়ার ধারনে ৭৮ কোম্পানির ব্যর্থ পরিচালকরা ব্যর্থ হলে বিএসইসির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। ফলে ৪৩ কোম্পানির স্পন্সর পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ নেই।

এসব কোম্পানিকে তাদের বিদ্যমান শেয়ার ধারণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় শেয়ার সংখ্যা যোগ করে কোম্পানিগুলোর স্পন্সর পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের কোটা পূরণ করতে হবে। আর এই ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে কোটা পূরণ করতে কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনতে হবে। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ৪৩ কোম্পানিকে মোট ১১৭ কোটি ৩২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮টি শেয়ার কিনতে হবে বলে ডিএসই সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি বিএসইসির ৬২৯তম কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত সকল পরিচালকের জন্য সর্বদা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক। কাজেই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সমূহের স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত যেসকল পরিচালক কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ না করে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বিষয়টি এনফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠানো হবে।

এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর ও পরিচালকগণ সম্মিলিতভাবে সর্বদা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সে সকল কোম্পানির স্পন্সর ও পরিচালকগণের সম্মিলিতভাবে সর্বদা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ অবিলম্বে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি নির্দেশনা জারি করবে কমিশন।

২০১১ সালের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) জারি করা এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বর্তমানে কঠোর অবস্থানে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে পরিচালকদের শেয়ার কেনা-সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিরোধিতা করে পুঁজিবাজারকে যেন অস্থিতিশীল করতে না পারে সে ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।