dseদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে চায় চীনের পুঁজিবাজার সংস্থা শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ভারতীয় ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, নাসডাক ও ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ মিলে গঠিত কনসোর্টিয়াম।

তবে কার কাছে শেয়ার বিক্রি করা হবে তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)’র মধ্যে। সর্বোচ্চ দরের ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি নিয়ে ওই দুই সংস্থার মধ্যে এই মতবিরোধ, যা নিয়ে পুঁজিবাজারে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, চীনের পুঁজিবাজার সংস্থা শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারপ্রতি দাম দিতে চাইছে ২২ টাকা। যা অভিহিত মূল্যের বিপরীতে সর্বোচ্চ দাম। ফলে ডিএসই সিদ্ধান্ত নেয় চীনের দুই সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করা হবে উল্লিখিত ২৫ শতাংশ শেয়ার।

অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারের দাম দিতে চাইছে ১৫ টাকা করে। সেক্ষেত্রে ভারতের দাম চীনের দামের থেকে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা কম। তারপরও ভারতের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য ডিএসইকে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি- এমন অভিযোগ উঠেছে।

দুই সংস্থার বিদ্যমান মতবিরোধ প্রভাব ফেলছে পুঁজিবাজারের লেনদেনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৯শে জানুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতিকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাজারে আগে থেকেই অস্থিরতা চলছিল। মুদ্রানীতির পর ডিএসইর শেয়ার বিক্রি নিয়ে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুদ্রানীতির প্রভাবে গত ২৫শে জানুয়ারি থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ দিনই শেয়ারের দরপতন হয়েছে।

এ সময়ে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর সূচক কমেছে ২৫০ পয়েন্ট। গত সোমবার পুঁজিবাজার আবারো নিম্নমুখী হয়। পরের দুইদিন মঙ্গল ও বুধবার দিনভর সূচকের ব্যাপক উঠানামার পর দিনশেষে বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বৃহস্পতিবার ও সপ্তাহের প্রথম দিন গতকালও পুনরায় বড় ধরনের দরপতন হয়।

ডিএসই ও সিএসই সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ডিএসই প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৯৯ পয়েন্ট। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক কমেছে ২৫১ পয়েন্ট। এদিন ডিএসইতে মোট লেনদেনে অংশ নিয়েছে ৩৩৬টি কোম্পানি।

এর মধ্যে দর বেড়েছে ৪৯টির, কমেছে ২৭০টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ১৭টি কোম্পানির শেয়ার দর। অন্যদিকে সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২২৭টি কোম্পানির শেয়ার। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ১৭৬টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৪টির শেয়ার দর।

মূলত চীনের কোম্পানির পরিবর্তে কঠিন শর্তে এবং কম দামে ভারতীয় কোম্পানিকে শেয়ার দেয়ার খবরে পুঁজিবাজারের এ অস্থিরতা বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

সূত্র জানায়, ডিএসই’র শেয়ার বিক্রি ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি সরাসরি ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়। ডিএসই অনড় অবস্থানে থাকায় বিএসইসি অবস্থান বদল করে ভারত ও চীন উভয় দেশের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য নতুন করে চাপ দেয়। বিপরীতে ডিএসই’র মেম্বাররা এখনো শুধু চীনের কাছে শেয়ার বিক্রির অবস্থানে অনড় রয়েছেন বলে জানা গেছে।

ডিএসই’র বর্তমান পরিচালক ও সাবেক সভাপতি মো. রকিবুর রহমান বলেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী যারা শর্ত পরিপূর্ণ করছে তাদেরকেই দিতে হবে। চীন আমাদের দরপত্রের শর্ত পরিপালন করেছে, আমরা তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটাই শেষ কথা। তিনি বলেন, চীন ও ভারতের প্রস্তাব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখছি, একটি দেশ খাপছাড়া প্রস্তাব করেছে। আরেকটি জেনুইন প্রস্তাব করেছে। ফলে একটির সঙ্গে আরেকটির তুলনা হয় না।

অন্যদিকে গত শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি দাবী করে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুতে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। একইসঙ্গে এ ঘটনায় বিএসইসি চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করে এর তীব্র নিন্দা জানায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নকল্পে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিএসই’র উন্নয়নকল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতি, কারিগরী দক্ষতা ও উৎর্ষতা অর্জনে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কৌশলগত বিদেশী অংশীদার বাছাই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিএসইসি’র অনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্খিত। রক্ষক হয়ে বিএসইসি ভক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাও দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজসে বা প্রভাবান্বিত হয়ে।

তিনি বলেন, দর প্রস্তাব মূল্যায়নে প্রায় অর্ধেক পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের তদবির ও চাপ প্রয়োগ যেমন নজিরবিহীন ও আইনবিরুদ্ধ, বিএসইসি কর্তৃক তাতে প্রভাবিত হয়ে বাছাই প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে ইন্ধন যোগানো তেমনই বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিয়ম ও অস্থিতিশীলতায় জর্জরিত শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত বিএসইসি কর্তৃক এ অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করে বাছাই প্রক্রিয়ায় শীর্ষস্থানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা ও অবৈধ চাপ সৃষ্টিকারী দরদাতাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে বিএসইসিতে এ ধরনের হীন প্রচেষ্টার সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে শনিবার জরুরি সভায় বসে বিএসইসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। টিআইবির করা মন্তব্যের করা জবাব দেয় বিএসইসি। ডিএসই স্ট্রাটেজিক পার্টনার নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএসইসি। এ বিষয়ে শুক্রবার টিআইবি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটিকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছে বিএসইসি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে কারা আবেদন করেছে সে সম্পর্কে বিএসইসি বিস্তারিত কিছু জানে না। কারণ এখনো তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাঠায়নি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। এমন অবস্থায় বিএসইসি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থানে নেই। অথচ তাদের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের হয়ে চাপ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে টিআইবি।

এ অভিযোগ করার আগে তারা একবারের জন্য বিএসইসির সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, তাদের বক্তব্য নেয়নি। বিএসইসির বিরুদ্ধে টিআইবি যেসব অভিযোগ করেছে, তাকে আপত্তিকর বলে অভিহিত করেছে বিএসইসি।

যার নেতিবাঁচক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়ছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন বিএসইসির ও ডিএসইর মধ্যে এই ইস্যুতে টানা পোড়নের কারণে নেতিবাঁচক প্রভাব পড়ছে বাজারে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, ৯৯ পয়েন্ট পড়ার মত এমন কোনো কারণ নেই। তবে এই মহুর্তে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগারী ইস্যু ছাড়া তেমন কিছু নেই। এই ইস্যুতে নতুন করে বিনিয়োগকারীর মধ্যে আস্থার চির ধরেছে। যার নেতিবাঁচক প্রভাব পড়ছে বাজারে।

একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমদ। তিনি বলেন, এই মহুর্তে দেশের অর্থনীতির সব সূচকই ইতিবাঁচক। পুঁজিবাজার নেতিবাঁচক হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুর প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়ছে বলে মনে হয়।