dse lago deshprotikhonদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনা কনসোর্টিয়ামকে অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের দূতাবাস। গত সপ্তাহে মনে হয়েছিল, চীন নিশ্চিতভাবেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত অংশীদার হচ্ছে।

কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) চীনা দরপত্র নিয়ে মারাত্মক কিছু আপত্তি উত্থাপন করায় ওই নিশ্চিত অবস্থানটি বহাল থাকেনি। এসইসি দাবি করেছে, চীনা কনসোর্টিয়মের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের বিধিবিধানের পরিপন্থী।

তবে জনসাধারণ কূটনীতি ও অর্থ উভয়টিই হিসাবে রেখে ছায়াযুদ্ধ ধরে নিয়েছে। ফলে বিষয়টি কেবল সর্বোচ্চ দরদাতার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং কূটনৈতিক চাপও জড়িত রয়েছে। এটি আসলে ছোট অবয়বে ভারত-চীন মুষ্টিযুদ্ধ ম্যাচ, মাঝখানে পড়ে আছে কিছুটা হতভাগা বাংলাদেশ।

নিয়ন্ত্রণকারী বনাম স্টক এক্সচেঞ্জ: ডিএসইর কাছে লেখা চিঠিতে বিএসইসি শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের বেশ কিছু ‘লঙ্ঘনের’ বিষয় তুলে ধরেছে। বিএসইসির উত্থাপিত দুটি প্রধান বিষয় হলো: ক. ব্রিটিশ আইনে চুক্তি করা এবং যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তি আন্তর্জাতিক আইনে করা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আইনের বরখেলাপ। খ. অন্য যেকোনো কৌশলগত বিনিয়োগকারীকে গ্রহণ করার আগে ডিএসইকে বিদেশী বিনিয়োগকারীর অনুমোদন গ্রহণ করার কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবটি বাংলাদেশের আইনের লঙ্ঘন।

আর্থিক দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে থাকায় ডিএসই এখনো চীনা দরপত্রটির অনুকূলে রয়েছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা বিএসইসির উত্থাপিত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেবে। কিন্তু তবুও ছায়াযুদ্ধের খেলোয়াড়দের মধ্যকার সঙ্ঘাত দ্রুত শেষ হচ্ছে না। ডিএসই ও বিএসইসি যখন চীন-ভারত দরপত্র ম্যাচ নিয়ে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন খবর পাওয়া গেছে, বিএসইসি ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে দেওয়া ভারতীয় দরপত্রটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

খবরে প্রকাশ, চীন শেয়ারপ্রতি ২২ টাকা করে দর দিয়েছে, ভারত দিয়েছে ১৫ টাকা হিসেবে। কিন্তু কূটনৈতিক লড়াইসহ তীব্র সঙ্ঘাতময় পরিবেশ অনেক বিনিয়োগকারীকে ভীত করছে, অনিশ্চয়তার কারণে ডিএসইতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।

ডিএসই ও বিএসইসির মধ্যকার সঙ্ঘাতকে ছায়াযুদ্ধ বিবেচিত হওয়ায় সরকার এ যাত্রায় ভারতীয়দের দিকে ঝুঁকতে পারে। ইতোমধ্যেই ভারতপন্থী একটি লবি চীনা দরপত্রে উল্লেখিত শেয়ারপিছু দর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এ বলে যে এটি নির্ধারিত নয়, বরং ‘বিষয়কেন্দ্রিক ও শর্তসাপেক্ষ মূল্য প্রস্তাব’ হওয়ায় যতটা বেশি শোনায়, আসলে ততটা নয়। চীনা দরপত্র নিয়ে আরো যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সামর্থ্য সৃষ্টি বিনিয়োগ, নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে ভেটিং। এসব বিষয় ভারতীয় প্রস্তাবে রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

চীনা অর্থ, মিয়ানমারের উদ্বাস্তু ও ভারতীয় দরপত্রদাতারা: চীন-ভারত সঙ্ঘাত অনেক দিন ধরে চললেও বাংলাদেশের উপকূলে মাত্র গত বছর তা পৌঁছেছে। তা হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিতে। তবে মধুচন্দ্রিমা পর্ব শেষ হওয়ার আগেই রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমারের আবির্ভাব ঘটে দৃশ্যপটে। এতে এত বেশি জটিলতা দেখা দিতে থাকে যে বাংলাদেশের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত ও চীন উভয়েই তাদের সব কৌশল গোপন রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি ও অপারেশন করিডোর, বিশেষ করে অবকাঠামো খাতের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চীন তার আর্থিক সুবিধার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছে, তবে তার কূটনীতি নানা বাধার মুখে পড়ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় বাংলাদেশে তারা সমর্থন খুইয়েছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সমঝোতা স্মারকের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে চীন তার ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে চীনের অক্ষমতার ফলে আগে যতটুকু শক্তিশালী মনে হয়েছিল, সে ততটা নয় বলেই ধারণা জন্মেছে।

চীনা কূটনীতিকের বিদায় নিয়ে ধাঁধা: এদিকে চীনের নিজ ঘরে শুদ্ধি অভিযানও বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দৈনিক মানবজমিনে খবর বের হয়েছে, বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মা মিঙ কিয়াঙ নতুন পদে যোগদানের আগে বেইজিং থেকে বাংলাদেশে ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে তা করতে দেওয়া হয়নি। তাকে সফল কূটনীতিবিদ বিবেচনা করা হয়েছিল। তিনি চীনা প্রেসিডেন্টের সফর আয়োজন ছাড়াও চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তিতে জড়িত ছিলেন।

কিন্তু এখন গুজব রয়েছে, তিনি একটি চীনা কোম্পানির বদলে অপর একটি চীনা কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ায় বেইজিং তার বিরুদ্ধে সম্ভবত দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে। নতুন রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

ওই ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখনো উভয়ের জন্যই তরল রয়ে গেছে। অভিন্ন সীমান্তসহ নানা পর্যায়ের সম্পর্ক থাকার কারণে আর্থিক বিষয়াদির চেয়ে কূটনৈতিক শক্তি বেশি রয়েছে ভারতের। সম্পর্কের খাত সীমিত থাকায় চীন মূলত আর্থিক বিষয়ের ওপরই নির্ভর করে থাকে। কাজ করার সময় সে বেসরকারি খাত থেকে বন্ধু সংগ্রহ করার চেষ্টা করে।

তবে এর অর্থ এও যে বেইজিংয়ের শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকলে চীনপন্থী লবি বাংলাদেশে কাজ করতে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যে দেশে দুর্নীতি জীবনযাত্রার গ্রহণযোগ্য অংশ, সে দেশে চীনা বেসরকারি খাতগুলো বাংলাদেশী বেসরকারি খাতগুলোর কার্যক্রমের ধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। ওই ধারাটি এখন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

তবে চীন যে ধরনের বড় মাপের খেলা খেলছে এবং ভারতও তা করতে চাওয়ায় চীন-ভারত প্রশ্নে বিএসইসি ও ডিএসইর লড়াই আসলে খুদ-কুঁড়ার বিষয়। তবে এই মুহূর্তে যেটা মনে হচ্ছে তা হলো কোনো দেশের পক্ষেই যাত্রা সহজ হবে না। এমনকি ছোট অর্থনৈতিক ছায়াযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশ ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’-এর মতো করে যে বেশি অর্থ দেবে তার সাথে থাকতে রাজি থাকলেও।