bankদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নতুন প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের পরিচালক মাকসুদুর রহমান। ব্যাংকটির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান তিনি। বছর দুয়েক আগে তার মালিকানাধীন রতনপুর গ্রæপের নামে থাকা ছয়টি ব্যাংকে ৯২৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠনের মাধ্যমে কম সুদ ও অন্যান্য সুবিধা পেলেও ওই ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন খেলাপি।

আরেক নতুন ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়ালের পরিচালক কামরুন নাহার সাখী। দেশের ৯টি ব্যাংক থেকে সিলভিয়া গ্রুপের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে উধাও শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান শাহীনের স্ত্রী তিনি। সিলভিয়া গ্রæপের নামে নেওয়া অনেক ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। সাখী সিলভিয়া গ্রæপের একজন পরিচালক।

মাকসুদুর রহমান কিংবা সাখীর মতো অনেক ব্যাংক পরিচালক এখন ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালকদের নেওয়া ঋণের চার হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে কারও নাম বা পরিচালকের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু ব্যাংকের সংখ্যা উল্লেখ করে গত সেপ্টেম্বরভিত্তিক ঋণের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালকদের মোট ঋণ রয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে যা ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। পরিচালকদের বিপুল অঙ্কের ঋণের মাত্র তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা রয়েছে নিজেদের ব্যাংকে।

বাকি ঋণ নেওয়া হয়েছে অন্য ব্যাংক থেকে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণ রয়েছে সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এসব ঋণের ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা খেলাপি। এর বাইরে অবলোপন করা ঋণ রয়েছে আরও প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণও খেলাপি ঋণ। শতভাগ প্রভিশন রেখে পুরনো খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দেওয়াকে অবলোপন বলে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ঋণখেলাপি ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারেন না। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে অনেক পরিচালক পদে বহাল আছেন। অনেক পরিচালক আদালতের নির্দেশে খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোরও সুযোগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে পরিচালকদের বেনামি ঋণও রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, খেলাপি হওয়া পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। দ্রæততম সময়ে তাদের অপসারণ করতে হবে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে যাতে তারা সময়ক্ষেপণ করতে না পারে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও উদ্যোগী হতে হবে। দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে দ্রæততম সময়ে এ ধরনের রিট নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, ব্যবসার জন্য পরিচালকরা ঋণ নিতেই পারেন। এসব ঋণ যথাযথভাবে হচ্ছে কি-না তা তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ একটি সেল গঠন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যিনি যে ব্যাংকের পরিচালক, তার সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ খুব সামান্য। নিজেরা পরিচালক এমন ২৯টি ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তারা। আর নিজে পরিচালক নন এমন ৫৩টি ব্যাংক থেকে তারা নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। খেলাপি হয়ে যাওয়া চার হাজার টাকার সবই অন্য ব্যাংকে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, নিজে যে ব্যাংকের পর্ষদে রয়েছেন ওই ব্যাংক থেকে ধারণ করা শেয়ারের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন একজন পরিচালক। এ রকম ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বিএসইসিকে জানাতে হয়। পরিচালকের নেওয়া ঋণ শেষ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে গেলে তার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে ঋণের টাকা সমন্বয় করার বিধান রয়েছে। এসব কারণে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে তেমন আগ্রহ দেখান না পরিচালকরা। অবশ্য নিজ ব্যাংকে বেনামি ঋণ নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটে থাকে, যা বে আইনি।

ব্যাংক খাতসংশ্নিষ্টরা জানান, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকরা যোগসাজশের মাধ্যমে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। পরিচালক হওয়ার সুবাদে তারা তুলনামূলক কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করিয়ে দেন। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধের সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যান অনেক পরিচালক।

এ বিষয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিশেষ সুবিধা বা যোগসাজশের মাধ্যমে পরিচালকরা ঋণ নেওয়ার বিষয়ে এমডিরা অবহিত। তবে মালিক পক্ষের চাপে অনেক সময় তাদের হাত দিয়ে এ রকম অনৈতিক কাজ করতে হয়।