dse-up-dowenফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নির্বাচনী বছর পুঁজিবাজার অস্থিতিরতার নেপেথ্যে কারা এ প্রশ্ন এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বছর শেষে হতাশ বিরাজ করছে। সেই হতাশার বিরাজ আজও চলছে।

নিরবচ্ছিন্নভাবে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারছে না। ফলে আশা-নিরাশার দোলাচলে কেটেছে নির্বাচনী বছর। তার পরও বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বেঁধেছেন। পুঁজিবাজার ভালো হবে। কারন এ বছরের শেষদিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ কারণে সরকারও পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে শীর্ষ সিকিউরিটিজের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ জড়িত।

এছাড়া বর্তমান পুঁজিবাজারে সংকট না কাটিয়ে রাজনৈতিক ইস্যুর অজুহাত দেখিয়ে দায়সারা ভূমিকা পালন করছে নীতিনির্ধারণী মহল। টানা দরপতন বাজারের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও। তাছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে তুলকালাম, দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা ইত্যাদি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ।

তাই একটি স্থিতিশীল বাজার প্রতিষ্ঠা এখন সর্বস্তরের মানুষের কাম্য। যা বর্তমানে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না। ভালো খবরেও সাড়া দিচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দরপতনের কারণ ছিল ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর কমানো ও স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত অংশীদার নির্বাচনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপের বিষয়গুলো।

এছাড়া সরকারি ব্যাংকের অতিরিক্ত আমানত ফেরত দিতে গিয়ে আইসিবির শেয়ার বিক্রির চাপেও দরপতন মাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে সবর ইস্যুরই যৌক্তিক সমাধান হয়েছে। তারপরও শেয়ারদর ও সূচকের পতন থামছে না। দরপতন দীর্ঘায়িত হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এখনকার ঘটনা তার ব্যতিক্রম নয় বলে জানান মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেনদেন কম হওয়ার নেপথ্যে তারল্য সংকট প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ তারল্য সংকট কাটাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নির্দেশ দেয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে বর্তমান বাজারে অস্থিরতার পেছনে নীতিনির্ধারণী মহল রাজনৈতিক ইস্যুকে দায়ী করছেন। কিন্তু এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার কোনো পথ বের করছেন না। ফলে অস্থিরতা রয়েই যাচ্ছে। প্রতিদিন বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে অবস্থান করা কোম্পানির শেয়ার দর ক্রয়মূল্যের নিচে অবস্থান করছে।

এতে পুঁজি হারানোর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওর ইক্যুইটির ব্যালেন্স নেতিবাচক হচ্ছে। যে কারণে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এতে ব্যবসা পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। কর্মী ছাঁটাই, ব্যবসায়ের পরিধি কমানো ও মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে নিয়মিত। এ অবস্থায় বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো এখন বিনিয়োগকারী, সিকিউরিটিজ হাউজ মালিকদের প্রাণের দাবি হয়ে উঠেছে।

একটি সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারের দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে। ওই গোষ্ঠীটি বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে আরও বড় পতন হবে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছেড়ে দিতে প্রলুব্দ করছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, এ গুজুবের সাথে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহীরাও জড়িত। এছাড়া সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখনই তদন্ত করা উচিত।

নাম প্রকাশে অনিশ্চি’ক এক সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ বড় বিনিয়োগকারীর পরামর্শে শেয়ার কেনাবেচা করেন। বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকেটাই নিস্কিয়। এর কারণ আর্থিক খাতের বড় ধরনের টানাপড়েন। বড়দের থেকে দিকনির্দেশনা না থাকায় ছোট বিনিয়োগকারীরা অনেকে হাত গুটিয়ে আছেন।

আবার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে চলতি দরপতনে অনেক বিনিয়োগকারী বড় লোকসানে পড়েছেন। এরা নতুন করে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারছেন না। এ কারণে লেনদেন কমছে। বড় বিনিয়োগকারীদের নিস্কিয়তার ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে সংকট নিয়ে বিভিন্ন খবরকে দায়ী করছেন বাজার-সংশ্নিষ্টরা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন বড় বিনিয়োগে আসেনি। এমনটি জানিয়েছেন অপর এক মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনী বছর সরকার যে কোন মুল্যে পুঁজিবাজার ভাল করতে হবে। সম্প্রতি অর্তমন্ত্রী বলেছেন, পুঁজিবাজার যে কোন মুল্যে ভাল করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এর একটি অংশ আসবে পুঁজিবাজারে। যারা নির্বাচন করবেন তাদের আত্মীয় স্বজনরা বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাবেন। এর একটি অংশও পুঁজিবাজারে যাবে।

সরকারও পুঁজিবাজার চাঙ্গা রাখতে উদ্যোগী হবে। কেননা ভোটের বছর সব সরকারই পুঁজিবাজার ভালো রাখার চেষ্টা করে। পুঁজিবাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বিনিয়োগকারী ও তাদের ওপর নির্ভরশীল মিলে প্রায় ১ কোটি ভোটার রয়েছে। এ কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের তুষ্ট করতে পারলে এই ভোটের একটি অংশ সরকারের দিকে ঝুঁকবে।

এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনায় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সহযোগীতায় শেয়ারবাজারকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এর জন্য সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, পুঁজিবাজার যে কোন মুল্যে স্থিতিশীল রাখতে সরকার চেষ্টা করছে। বর্তমান পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটে হাহাকার। এ তারল্য সংকট কাটছে বাজার ঘরে দাঁড়াবো। আশা করছি ভোটের বছর পুঁজিবাজারের জন্য ভালো যাবে। সরকারও উদ্যোগী হয়েছে।

বিএমবিএর নব-নির্বাচিত সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, নির্বাচনী বছর পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইসিবি মরিয়া হয়ে কাজ করছে। এর সুফল শিগরিই পাওয়া যাবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আমরাও কাজ করতে চাই। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শেয়ারবাজার অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরো বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকার্সরা চাহিদা ও সমন্বয় উভয় বিষয়ে কাজ করে। আমাদের এই কমিটি সবাইকে নিয়ে চাহিদা ও সমন্বয়ের কাজটি সঠিকভাবে করতে চায়। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য শেয়ারবাজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শেয়ারবাজার শক্তিশালী হলে দেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়।

শাকিল রিজভী ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের মুল চাবিকাঠি পুঁজিবাজার। আর সরকার যে হারে দেশের উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য নিচ্ছে তাতে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই খুব শিগরিই বাজার ঘুরে দাঁড়াবো।

এম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী নুরুল আজম বলেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকার আন্তরিক। তবে বাজারে তারল্য সংকটের কারনে ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি তারল্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। লেনদেনকে যে কোন মুল্যে এক হাজার কোটি টাকার ঘরে নিতে হবে।

এমেস সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজার গত কয়েকদিনে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আতঙ্কিত। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। কারন পুঁজিবাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর ফেসভ্যালুর কাছাকাছি। এখন বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়।