dse dorpotonফাতিমা জাহান, মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত উত্থানের পর গত বছরের এপ্রিল থেকে চার ইস্যুতে টানা দরপতনের বৃত্তে আটকা পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এর মধ্যে মাঝে মাঝে সূচকের উকি মারলেও তা স্থায়ী হয়নি। সরকারের পক্ষ থেিেক পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও কার্যত কোনো ফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাজার কখনো একটানা ঊর্ধ্বমুখী আবার কখনো ক্রমাগত নিম্নমুখী।

সম্প্রতি কয়েক দফা ধাক্কায় টালমাটাল অবস্থায় এখন পুঁজিবাজার। সূচক কমার সঙ্গে কমছে ধারাবাহিক লেনদেন। প্রতিদিন বাজার মূলধন কমছে। আর শেয়ার বিক্রির চাপে কোম্পানির শেয়ার দামও কমছে। অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারী, রক্তক্ষরণ বাড়ছে তাঁদের। এরুপ নাজুক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ব্যাংক, পোটফলিও ম্যানেজমেন্ট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও দায়িত্বশীল আচরণ না করার কারণে রেডজোন থেকে বাজার ফিরে আসতে পারছে না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেছে, ব্যাংক, পোটফলিও ম্যানেজমেন্ট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে বরং নেতিবাচক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অব্যাহত পতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসানের পাল্লা ভারি করছেন। অন্যদিকে, সরকারের দায়িত্বশীল রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠানের কঠোর কিছু পদক্ষেপ বাজারকে কারসাজি চক্রের ফায়দা হাসিলে ভুমিকা রাখছে বলেও মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা হচ্ছে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী বছরে পুঁজিবাজার একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে আসবে। তবে বিনিয়োগকারীদের সে আশায় গুড়োবালি। ফলে বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা।

তারা আরো বলেন, পুঁজিবাজারে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মতো তেমন কোন উপাদান নেই। যেসব উপদান বাজারকে নেতিবাচক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেসব উপাদান এর আগেও পুঁজিবাজার অতিক্রম করেছে। কিন্তু এতো বড় পতনের ধাক্কা পুঁজিবাজারে এর আগে লাগেনি। ২০১৪ সালে রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলেও বাজারে এত দরপতন হয়নি। তাই এসব কারণে এত বেশি দরপতন হওয়ার কথা নয়। নতুন বছরে বিনিয়োগ মৌসুম হওয়া সত্তে¡ও নানা রকম গুজব ছড়িয়ে একটি গোষ্ঠি কম দরে শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার জন্য পুঁজিবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে তাঁদের অভিমত।।

একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা বলেছেন, পুঁজিবাজারের এই উত্থান-পতন অস্বাভাবিক। বাজারের এ টালমাটালের পেছনে মূলত চার ইস্যু দায়ী। ইস্যু চারটি হলো ব্যাংকের এডিআর, বিনিয়োগসীমা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইসিবির নিস্কিয়তা।

এম সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী নুরুল আজম বলেন, বছরের শুরুতে আগের বছরের ধারাবাহিকতায় স্থিতিশীলতার পথে এগোলেও কয়েক দফা ধাক্কায় পুঁজিবাজার এখন বিপর্যস্ত। নতুন নতুন ইস্যুতে না জেনে না বুঝে, আবার গুজব ও মিথ্যা তথ্যে প্রভাবিত হয়ে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় পুঁজিবাজারও একদম তলানিতে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটে হাহাকার করছে। বাজারে লেনদেন নেই বলে চলে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাউজ বন্ধ হবার উপক্রম হবে। এ বিষয় এখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থা নজর না দিলে কোটি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একদিকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, অন্যদিকে সেগুলোতে বাধা দেওয়া হয়। ২০১০ সালে ধসের পর অনেক সংস্কার হয়েছে। বারবার ধাক্কায় বাজারের ভিত নড়ানো হয়েছে। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে না পারায় তারাও শেয়ার বিক্রি করছে। যেকোনো মূল্যেই বাজারের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে অনেকটা ভালোভাবে শেয়ারবাজার চলার পর নতুন বছরেও ভালো ছিল। বছরের প্রথমে পুঁজিবাজারে ধাক্কা লাগে মুদ্রানীতি ইস্যুতে। ব্যাংকের ঋণ-আমানতের হার কমানো ইস্যুতে শেয়ার বিক্রি বাড়লে নিম্নমুখী হয় বাজার। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি। নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ভয়ে অনেকে মূলধন ফিরিয়ে নেয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও এখন হাত গুটিয়ে বসে আছে।

ব্যাংকের ঋণে লাগাম টানতে ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণ (এডি) অনুপাত কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের ৮৫ টাকা ঋণ দিত ব্যাংক আর ১৫ টাকা জমা রাখত। এই অনুপাত কমিয়ে ৮৫ টাকার পরিবর্তে ৮৩.৫০ টাকা আর শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বদলে ৮৯ শতাংশ করা হয়।

আর বাড়তি ঋণ সমন্বয়ে ছয় মাস বা জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে ২২ ফেব্রæয়ারি এক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সময় বাড়িয়ে সমন্বয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ায়।

প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধন বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমায় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্সপোজারে কোনো কোম্পানির শেয়ারে কেনা দামের পরিবর্তে বাজারদরে ধরা হয়। এতে কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়লে এক্সপোজার অতিক্রম করে। ফলে নিয়মের মধ্যে চলতেও শেয়ার বিক্রি করতে হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করায় বাজার নিম্নমুখী হয়।

জানা যায়, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অনানুষ্ঠিক এক বৈঠকে শেয়াবাজারের ক্রমাগত পতনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই বৈঠকে রাষ্ট্রায়াত্ব বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কে বাজারে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেন। একই বৈঠকে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এক্সপোজার লিমিট ক্রয় মূল্যে হিসাব করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে আইসিবি বাজারে সক্রিয় থাকলেও এক্সপোজার পরিবর্তন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখন পর্যন্ত কোন নড়াছড়া নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে বিষয়টি সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করবে বলে জানা যায়।

বাজারের এই নিম্নমুখিতায় ব্যাংকে এডিআর কমানোকেই প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এমন অবস্থা কোনোমতেই কাম্য না। মুদ্রানীতিতে ব্যাংকের এডিআর হার কমানোতে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহে বাধ্য করা হয়েছে। আর বেশি সুদে আমানত রাখার সুযোগ থাকায় অনেকে পুঁজিবাজার বিমুখ। শেয়ার বিক্রি করে সঞ্চয় করছে।’

আবু আহমেদ বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি প্রয়োজন। এডিআর কমানোয় বেশি সুদে ব্যাংক আমানত নিচ্ছে, তারাও বেশি সুদে ঋণ দেবে। কাজেই বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। এটা বিনিয়োগনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শেয়ারবাজারের দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। পুঁজিবাজারের এক্সপোজার ইস্যুতে ডিএসই’র সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, শেয়ার এক্সপোজার লিমিটি মার্কেট প্রাইসের পরিবর্তে কস্ট প্রাইসেই বাঞ্চনীয়। এতে আর্থিক ব্যত্যয় হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজারের ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টির দ্রæত ফয়সালা করা উচিত। অন্যথায়, একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের আক্রোষ ক্রমেই বেড়েই চলছে।