alig-lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘ ২০ বছর পর ঘোষিত সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নবগঠিত কমিটি ঘিরে দলের নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভই দেখায় দেয়নি, রীতিমতো বিস্ময় ও কৌতূকের সৃষ্টি করেছে।

বলাবলি হচ্ছে, এককালের জাসদ, বাসদ ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আসা কর্মীদের কমিটিতে জয়জয়কারই ঘটেনি, এটি জেলা সভাপতি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনের ভাগ-ভাটোয়ারার কমিটিতে পরিণত হয়েছে।

জেলা সভাপতি মতিউর রহমান রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রবাসী নিজের ছেলে মশিউর রহমান জুয়েলেকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী কামরুল হাসানকে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে বসিয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন তাঁর লন্ডন প্রবাসী ভাই ফজলুল কবির তুনিহকে জেলা কমিটির সদস্য করেছেন।

আরেক ভাই খায়রুল কবির রুমেনকে সহসভাপতি পদে বসিয়েছেন। অথচ দলের পোড় খাওয়া নেতাকর্মী এমনকি সংসদ সদস্যরাও সহসভাপতি পদে স্থান পাননি।

যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ কাশেমকে সহসভাপতি করা হয়েছে। রাজনীতি বা সমাজে প্রভাব নেই এমন ব্যক্তিদের সহসভাপতি পদ দেয়া হয়েছে। জেলায় ১১টি উপজেলা থাকলেও সহসভাপতি পদে সাধারণ সম্পাদকের উপজেলা জগন্নাথপুর থেকেই চারজন সহসভাপতি দেয়া হয়েছে। সভপতির এলাকা দিরাই থেকেও অনেককে কমিটিতে রাখা হয়েছে।

দলের সম্পর্ক নেই, রাজনীতিতে অপরিচিত সাধারণ সম্পাদকের এক মামাকে জেলা কমিটিতে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। বলাবলি হচ্ছে, বাপ-বেটা, মামা-ভাগ্নে ও ভাই-ভাই কমিটি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সাবেক জেলা সাধারণ সম্পাদক ও নন্দিত পৌর মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল দেড় মাস আগে মারা গেলেও বৃহস্পতিবার রাতে অনুমোদিত কমিটিতে সহসভাপতি পদে তাঁকে রাখা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে আইয়ুব বখত জগলুলের সঙ্গে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজনীতি করেছেন, তাদের কাউকেই জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাঁই দেয়া হয়নি।

অতীতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির জন্য রাজপথে শ্রম-ঘাম ঝরানো নেতারা নিজের কর্মের মূল্যায়নের জন্য দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষার পর ঘোষিত কমিটি দেখে ক্ষুব্ধ আর চরম হতাশ হয়েছেন।

কমিটি প্রকাশের পর দলের মূলধারার ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, হাইব্রিড ও তোষণের অভিযোগ ওঠে কমিটি গঠনের দায়িত্বে থাকা জেলা সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনের বিরুদ্ধে। দুই বছর আগে ১৮ বছরের পুরোনো কমিটি ভেঙে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় ওই দুই নেতাকে।

ঘোষিত কমিটিতে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে দলীয় কর্মকাণ্ডে আজীবন সক্রিয় বেশিরভাগ সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা পদ-পদবী থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জেলা ছাত্রলীগের বেশিরভাগ সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভাগ্যে পদ-পদবি জোটেনি। কমিটিতে বঞ্চিত হয়েছেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও জিএসরা।

৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিয়োগান্তক ঘটনার পর চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জেলা ছাত্রলীগের হাল ধরেছিলেন মতিউর রহমান পীর। বিগত কমিটির সদস্য ও ৭৫ পরবর্তী জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও দু:সময়ে দুবারের জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা এই নেতার স্থান হয়নি ৭৫ সদস্যের কমিটিতে। ৭৫ পরবর্তী দলের আরেক নিবেদিত সংগঠক আমির হোসেন রেজার নাম নেই জেলা কমিটিতে।

ঠাঁই হয়নি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, তিনবারের ইউপি চেয়ারম্যান ও এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওয়াহিদুর রহমান সুফিয়ানের। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহাবু তারেক, নজরুল ইসলাম মাসুক এবং জিতেন্দ্র তালুকদার পিন্টু ও আক্তারুজ্জামান সেলিম, তনুজ কান্তি দেসহ কেউই কমিটিতে স্থান পাননি।

৭৫ পরবর্তী সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের হয়ে ভিপি, জিএস পদে নেতৃত্ব দিয়ে ঝড় তোলা ছাত্রসংসদে ছাত্রলীগ নেতা মানিক লাল দে, আজহারুল ইসলাম শিপার, মনিষ কান্তি দে মিন্টু- এদের কেউই স্থান পাননি কমিটিতে। পদ বঞ্চিত হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি দিপঙ্কর সেন রিবু, নবনী কান্ত দাস ও পলিন বখত প্রমুখ নেতারা।

জেলা কমিটিতে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা নেই কিন্তু সভাপতি-সেক্রেটারির স্বজন আর অনুগত- এমন গুণ থাকায় অনেকে ভাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী। স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকেও প্রাধান্য দেয়ায় ক্ষোভ সবখানে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুপরিচিত নন এমন বসন্তের কোকিলদেরও ছাড়াছড়ি রয়েছে কমিটিতে। কোষাধ্যক্ষ পদ পাওয়া ইশতিয়াক শামীম এক সময় বাসদ করতেন। স্থায়ীভাবে থাকেন সিলেটে। কোন দিন ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনীতি না করা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা অভিজিৎ চৌধুরী পেয়েছেন সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকের পদ। স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. আবুল কালাম চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন না আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় কোন নেতা।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ ১৮ বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মতিউর রহমানকে সভাপতি ও এম. এনামুল কবির ইমনকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর দুই বছর এক মাস পর বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়।