lagoফাতিমা জাহান , দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের টালমাতাল পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি ফিরে পাচ্ছেন না। দেশের দুই পুঁজিবাজারে একদিকে রয়েছে তারল্যের সঙ্কট অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। পুঁজিবাজার উন্নয়নে সকারের নেওয়া নানা উদ্যোগও কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে চলছে অস্থিরতা।

আর বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও তারল্য সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না। বর্তমান বাজার নিয়ে সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা বাজার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে কোনো গতি নেই। টানা মন্দার কবলে বাজার। প্রতিদিন প্রায় সব ধরনের শেয়ারের দর কমছে। কমছে লেনদেন। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিকার নেই, নেই কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ।

এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের তীর ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ) দিকে। তাদের অভিমত, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আগে অনেক স্বপ্ন দেখানো হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। বাজারে গতি ফেরাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পাঁচ বছরেও দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ডিমিউচুয়ালাইজেশন যেন ‘গলার কাঁটা’। ২০১৩ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশন হওয়ার পরে ভালো মৌল ভিত্তির কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। বাজারে চালু হয়নি নতুন কোনো পণ্য। পুঁজিবাজারকে ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যর্থ তারা। এ কারণেই ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কোনো সুফল বাজারে লক্ষ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধসের পরে বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপরে জাতীয় সংসদে ‘এক্সচেঞ্জেস ডিমিউচুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস হয়। একই বছরের মে মাসে গেজেট প্রকাশের পরে শুরু হয় ডিমিউচুয়ালাইজেশন কার্যক্রম। এতে নতুন আশায় বুক বাঁধে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর পাঁচ বছর পরেও তাদের আশা এখনও হতাশার মধ্যেই রয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন যথাযথভাবে হয়নি। বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে ৪০ শতাংশ ট্রেকহোল্ডার রেখে প্লেয়ারদের সঙ্গে মিউচুয়ালাইজড করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেকহোল্ডাররা পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা। তারাই ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে পতনের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন তিনি।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতে, দেশের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের করতে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে আইন পাস হলেও দীর্ঘ পাঁচ বছরে কোনো সাফল্যের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এখনো সুদূরপরাহত। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে বাজারে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। ডিমিউচুয়ালাইজেশন-পরবর্তী নতুন পণ্য পুঁজিবাজারে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বিনিয়োগ করতে পারছে না পুঁজিবাজারে। ফলে অর্থ সঙ্কটে ভুগছে পুঁজিবাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরঞ্জিত কারনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নমনীয় হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করলে পুঁজিবাজারে দ্রæত ঘুরে দাঁড়াবো।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, বিনিয়োগের জন্য প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকগুলো যাতে অবশ্যই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এ ব্যাপারে শুধু মৌখিক নির্দেশনা নয় প্রয়োজনে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে আইন করে দেয়া উচিত। যাতে কোনো ব্যাংক এই টাকা পুঁজিবাজারের বাইরে বিনিয়োগ করতে না পারে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারের গত সাড়ে সাত বছরে ধস পরবর্তী বাজার রক্ষায় নীতিনির্ধারক মহল থেকে অসংখ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখেনি। আর সফলতা না আসার কারণেই পতনের বৃত্ত থেকে বাজারকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। মূলত একশ্রেণীর বিনিয়োগকারীর স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগের কারণেই আস্থার অভাব বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে চলতি বছরের শুরু থেকেই টালমাটাল পুঁজিবাজার। সম্প্রতি আস্থা ও তারল্য সংকটে মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের বলছেন ‘পুঁজিবাজার আর ভালো হবে না’ ‘শেয়ার কিনলেনই লোকসান হচ্ছে’। এমন অবস্থাতেও ডিএসই-সিএসই প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করার পরের দিন একটু দাম বাড়াচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা একটু আশস্ত হচ্ছে। এরপর আবারও চলছে দরপতন।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ ডিএসই-সিএসই সহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকারীদের ডেকে এনে ফকির বানাচ্ছে। এতে পুঁজি হারানোর ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে শেয়ার ব্যবসায়ীরা লোকসানের ভারে অথৈই সাগরে ডুবছে।

আজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অবস্থিত লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজ, শাকিল রিজভী স্টক, এম সিকিউরিটিজ ,স্টার লিংক সিকিউরিটিজ, ব্র্যাক ইপিএলসহ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের বিনিয়োগকারী আশিকুর রহমান বলেন, সরকার ইচ্ছা করলেই পুঁজিবাজার ভালো হবে। এটা সরকারের জন্য ওয়ান টু’র ব্যাপার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত কিছু বাস্তবায়ন করতে পারলে পুঁজিবাজার কি ভালো করতে পারবে না। কিন্তু সরকার বিনিয়োগকারীদের ডেকে এনে ধীরে ধীরে পুঁজি কেড়ে নিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের সর্বশান্ত করছে।

তিনি বলেন, ডিএসই’র অংশীদারিত্ব চীনা কনসোর্টিয়ামকে দিয়ে দিলেই এখন বাজার ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু সরকার এটা করছে না। ফলে সরকার (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কারণে পুঁজিবাজার দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। ফলে ডিএসই ও বিএসইসির যাতাকলে আমরা সর্বহারা হয়ে গেলাম। মিছিল-মিটিং করে বাজারে এ অবস্থা থেকে উত্তোলন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন একই হাউজের বিনিয়োগকারী শহিদুল ইসলাম ইকবাল।

তিনি বলেন, টানা কয়েক দিন পরপর দরপতন ঠেকাতে ডিএসইতে মিটিং করা হয়। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে দু-একদিন বাজার ভালো রাখা হয়। এরপর আবারও চলে দরপতন। আর এই দরপতনের প্রতিবাদে ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ হয়। ফলে বাজারে নিয়ে কোনো ভরসা পাচ্ছি না। প্রতিদিনই পুঁজি কমছে, খুব আতঙ্কে আছি।

ব্র্যাক ইপিএলের বিনিয়োগকারী ইমরুল গালিব বলেন, পৃথিবীর এমন কোন পুঁজিবাজার আছে, যে ৮ বছরেও গতিশীল হয়নি। বরং যখনই বাজার যখন আপন গতিতে একটু ঘুরে দাঁড়ায়, ঠিক তখনি বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসিসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বাজারটাকে অস্থিতিশীল করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজার বিরোধী কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু বিএসইসি ইগো প্রবলেমের কারণে সেগুলো সমাধান করছে না। পাশাপাশি কমিশন নিজে চীনা কনসোর্টিয়ামকে ডিএসইর অংশীদারিত্ব না দিয়ে ভারতেকে দিতে চাচ্ছে। এতে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

শাকিল রিজভী স্টকের বিনিয়োগকারী আতাউর রহমান বলেন, এডি রেশিও, ডিএসইর অংশীদারিত্বে চীন-ভারতের টানাটানির কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন চলছে। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বাজারটাকে ঠিক করা দরকার।

বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দ্রæত লেনদেন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে কি করবে না তা তাদের ব্যাপার। তারা যেখানে বিনিয়োগ করে বেশি প্রোফিট পাবে সেখানেই তাদের বিনিয়োগ করা উচিত।

শেয়ার বাজারকে যদি তারা প্রোফিট্যাবল জায়গা মনে করে তাহলে এখানে করবে নচেৎ অন্য কোথাও। কারন ব্যাংকগুলোকে যদি এভাবে বিনিয়োগে বাধ্য করা হয় আর বছর শেষে লোকসান দেয় সেক্ষেত্রে আলটিমেটলি বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই শেয়ার বাজারকে চলতে দেয়া উচিত তার আপন গতিতে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘ধসের পর নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের অবস্থা আট বছরেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লক্ষ্য স্থির করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করতে পারেনি বলেই আস্থা ফিরে পাননি বিনিয়োগকারীরা।’

বিনিয়োগকারী নেতা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে যে ধস শুরু হয়েছিল, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর পরিবার এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।’ নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় পুঁজিবাজার সুসংগঠিত করতে সরকারের সহায়তা কামনা করেন তিনি।ডিমিউচুয়ালাইজেশন ‘গলার কাঁটা’!