icb-logoফাতিমা জাহান ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্বার্থে ৫টি মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান বিনিয়োগকারীরা। দেশের শেয়ারবাজারে একাধিকবার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইসিবির ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

বিশেষ করে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব হলেও দীর্ঘ আট বছরেরও অধিক সময় ধরে সঙ্কট উত্তরণে আইসিবির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। আর আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করলে সম্প্রতি পুঁজিবাজারের নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। প্রতি অর্থবছরে ঈর্ষণীয় মুনাফা করলেও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, আইসিবির ৫টি মূলনীতির মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, সঞ্চয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ব্যবসায়িক উন্নয়নে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মূলনীতির কোনোটাই যথাযথ পালন করে না আইসিবি। যদি নিয়মানুযায়ী আইসিবি কর্তৃপক্ষ কর্মকান্ড পরিচালনা করত তবে বাজারে কোনোভাবেই এমন নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। সম্প্রতি আইসিবির শেয়ার বিক্রির কারনে বাজারে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি।

তাদের মতে, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণের বিষয়ে আইসিবির তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। এছাড়া বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টিও বিনিয়োগকারীদের জানার বাইরেই থেকে যায়। সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা আইসিবির ভূমিকাকে বড় করে দেখতে চান না। কারণ দীর্ঘ আট বছরেও আইসিবি সরকারি ২৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে যুক্ত করতে পারেনি।

p-2বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইসিবির মাধ্যমে বাজারের নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ খেলোয়াড়দের হাতেই রয়ে গেছে। তাই আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব্ব পালনে কতটুকু সফল তা পর্যালোচনার বিষয়।

সম্প্রতি ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার একটি সংবেদনশীল জায়গা। এখানে আইসিবিকে গঠন করার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে তারা পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আইসিবি কি সে ভুমিকা পালন করছে কি না। আমার মতে দেশের বাজারে আইসিবি সবচেয়ে বড় প্লোয়ার বা ম্যাকার বা গ্যাম্বলার-যা-ই বলুন না কনে। এখানে ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠান আইসিবির ধারে কাছেও নেই। আর আইসিবির গম্বেলিং করা মানে সরকাররে গ্যাম্বিলং করা। দেশের অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো, তার পরও বাজাররে এমন অবস্থা আসলে চিন্তার বিষয়।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক একটি অনিশ্চিয়তার গুজব ফ্রেবুয়ারীর ৮ তারিখে কেন্দ্র করে হয়েছিল, কিন্তু  সেসময়  রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনো অস্থিতিশীলতা দেখা যায় না। কিন্ত এখন বাজারের এমন অবস্থা হচ্ছে কেন, সেটাই আসলে চিন্তার বিষয়।

একাধিক বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, আইসিবি নিজে মুনাফা করতে ব্যস্ত। যে কারণে বাজারকে সাপোর্ট দিতে এ প্রতিষ্ঠান তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। যাও রাখে তা দায়সাড়া। যে কারণে ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর দীর্ঘ আট বছরের ও বেশি সময় বাজার নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তারা আইসিবিরি ভূমিকা তদারকির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আইসিবি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যই আইসিবির জন্ম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর নিজের মুনাফা বাড়াতে ব্যস্ত থাকে। তারা পুঁজিবাজারে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম ক্ষুদ্ধ। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিকে বিনিয়োগে আসতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে এটিও প্রকাশ করা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নভেম্বরের একটি চিঠিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এ  অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যাংক মেয়াদি আমানত রেখেছিল, তার একটি অংশ তারা তুলে ফেলছে। নতুন করে আরও কয়েকটি ব্যাংক আমানত প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে পারছে না আইসিবি। সংকট মোকাবিলায় এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে সরকারি এই বিনিয়োগ সংস্থাটি।

জানা গেছে, গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে আইসিবির মেয়াদি আমানতে তাদের (ব্যাংকগুলোর) যে বিনিয়োগ রয়েছে, তার একটি বড় অংশ তুলে ফেলার নির্দেশনা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো আইসিবিতে মেয়াদি আমানত স্কিমে রাখা তাদের বিনিয়োগের একক গ্রহীতার ঋণ সীমার (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) অতিরিক্ত অর্থ তুলে নেয়।

এতেই বিপাকে পড়ে আইসিবি। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংককে সীমার অতিরিক্ত অর্থ বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে আইসিবি। এখন নতুন করে আরও কয়েকটি ব্যাংক বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আবেদন করেছে। ওই টাকা পরিশোধের জন্য এখন শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডে আইসিবির যে বিনিয়োগ আছে তা তুলে ফেলতে হবে। কিন্তু এটা করতে গেলে পুঁজিবাজারেও তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে শেয়ারবাজারে।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমানের কাছে পাঠানো চিঠিতে আইসিবির এমডি কাজী ছানাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪-এর দুটি সার্কুলার আকস্মিকভাবে ২০১৭ এর নভেম্বরে এসে কার্যকর করায় ৭-৮টি ব্যাংক একযোগে তাদের বিনিয়োগ থেকে সীমার অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

ফলে একদিকে যেমন আইসিবির পক্ষে বর্তমান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে স্পর্শকাতর এই সময়ে সিকিউরিটিজ বিক্রির মাধ্যমে অল্প সময়ে বড় অংকের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হলে শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আইসিবির এমডি আরও জানান, এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংককে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় একক ঋণ গ্রহীতার সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

বর্তমান অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতিতে এ মুহূর্তে অন্য ব্যাংকগুলোর চাহিদামাফিক অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য ব্যাংকবহির্ভূত সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ পরিশোধ করা যেতে পারে বলে মনে করছে আইসিবি।

এ জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যাতে সরকারি সংস্থাগুলোকে চিঠি লিখে আইসিবিতে আমানত রাখার বিষয়ে উৎসাহিত করে সেটাই আশা করছে সরকারি বিনিয়োগ সংস্থাটি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত রাখার বিষয়ে আগে থেকেই সার্কুলার আছে। নতুন করে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ওই সার্কুলার অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ আমানত সরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখতে হয়। বাকি ২৫ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা যায়। তাই আইসিবিতে আমানত রাখার বিষয়ে পৃথক কিছু করার দরকার আছে বলে আমরা মনে করি না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আইসিবির পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও নিজস্ব তহবিল থেকে প্রত্যাশানুযায়ী বিনিয়োগ করছে না। উল্টো অধিক মুনাফার আশায় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা মেয়াদি আমানত জমা রাখছে। অথচ পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিজস্ব তহবিল থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে বাজার স্থায়ী স্থিতিশীলতার পথে অগ্রসর হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। সে হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করলে বাজার ইতিবাচক ধারায় অনেক আগেই ফিরত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ বিনিয়োগকারীর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে। এতে করে নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ সুদসহ ঋণ পরিশোধ করার কারণে বাজারে দরপতনের ধারা ত্বরান্বিত হয়। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। অথচ আইসিবি অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ করে প্রতি অর্থবছরেই রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে।

পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বিনিয়োগ না করার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলেন, আইসিবি সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতো অতি মুনাফার আশা করে।

এ ব্যাপারে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে তারা কি ধরনের ভূমিকা রাখছে, তা পোর্টফলিও বিশ্লেষণ না করে বলা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় আইসিবির বড় ধরনের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। বাজারের স্বার্থে আইসিবির বাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।