pharma-aidমোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি ফার্মা এইডে রয়েছে রিজার্ভের ছড়াছড়ি। কোম্পানিটির পাহাড় সমান রিজার্ভ থাকলে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত ৪ বছরে কোম্পানিটির মুনাফায় বড় উল্লম্ফন দেখা দিলেও ডিভিডেন্ডের ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লফন নেই।

সবকিছুই গতানুগতিক। তাছাড়া কোম্পানিগুলোর নীতিমালা না থাকায় রিজার্ভ বৃদ্ধিতে চলছে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। একটি কোম্পানির কি পরিমাণ অর্থ রিজার্ভ থাকবে তার সীমা না থাকায় রিজার্ভের পাহাড় গড়ছে।

কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফা করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে রিজার্ভের নামে সংরক্ষণ করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, আর পরিচালকরা এক পর্যায়ে সে রিজার্ভের মালিক হচ্ছেন।

কোনো কোম্পানির রিজার্ভ যদি পর্যাপ্ত না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পেতে বিপাকে পড়তে হয় সে কোম্পানিকে। আবার কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে লভ্যাংশ না দিয়ে রিজার্ভ বাড়ালে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন বিনিয়োগকারীরা।

তবে রিজার্ভের স্ফীতি বিনিয়োগকারীদের জন্য কতটা লাভজনক এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতভেদ থাকলেও পুঁজিবাজারে চলছে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৯৩টি কোম্পানির কাছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার রিজার্ভ এন্ড সারপ্লাস রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের মুনাফার লভ্যাংশ না দিয়ে অধিকাংশ কোম্পানিই রিজার্ভের পাহাড় গড়ে তুলছে। তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি কী পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারবে এবং কীভাবে সেই রিজার্ভ ব্যয় করবে এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসাধু প্রতিযোগিতা চলছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির আস্থার হাতিয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফা করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে রিজার্ভের নামে সংরক্ষণ করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, আর পরিচালকরা এক পর্যায়ে সে রিজার্ভের মালিক হচ্ছেন।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাধিক কোম্পানি তাদের পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণ করছে। আবার কিছু কিছু কোম্পানি তার অনুমোদিত মূলধনের চেয়েও অনেক বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণ করছে। বছরের পর বছর এসব কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ালেও ডিভিডেন্ডের পরিমাণ কমছে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতে, ফার্মা এইডের পরিচালকরা কাগজ-কলমে মুনাফা কম দেখিয়ে বছর শেষে কম লভ্যাংশ দিচ্ছেন। রিজার্ভ ভেঙে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যাপকভাবে দেখা গেলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে খুবই কম বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

তাদের মতে, রিজার্ভের পাহাড় না জমিয়ে সে টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে বাজারের তারল্য সংকট কেটে যাবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ থেকে লভ্যাংশ দিলে বিনিয়োগকারীরাও লাভবান হবেন বলে আশা তাদের। বিএসইসিকে কোম্পানিগুলোর রিজার্ভ বেশি রাখার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। অন্যদিকে কোম্পানির উৎপাদনে লোকসান হলে আবার উৎপাদনে ফিরে আসতে যে পরিমাণ রিজার্ভ ফান্ড দরকার, সেটা রিজার্ভে রাখা দরকার।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের দ্বিগুণ টাকা রিজার্ভ ফান্ডে রাখা যুক্তিসঙ্গত। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানির রিজার্ভ বেশি থাকাও যথোপযুক্ত। অন্য খাতের যেসব কোম্পানি দ্বিগুণের বেশি রিজার্ভ রাখছে, তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে কোম্পানিগুলো বলছে, বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির ঝুঁকি এড়াতে রিজার্ভে মোটা অঙ্কের টাকা রাখা হচ্ছে। মুনাফার কত শতাংশ রিজার্ভে রাখা যাবে কিংবা রিজার্ভের সাইজ কতটুকু হবে এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। নেই কোনো জবাবদিহিও।
১৯৮৭ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর ২৬ বছরে কোম্পানিটির রিজার্ভ হয়েছে ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

আর গত ৪ বছরে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় সমপরিমাণ। বর্তমানে কোম্পানির রিজার্ভের পরিমাণ ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ৩১ লাখ ২০ হাজার শেয়ারের স্বল্প মূলধনী এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি এখন রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯.৫০ টাকা, যা পরিশোধিত মূলধনের প্রায় চার গুণ। কোম্পানিটি হলো ওষুধ ও রসায়ন খাতের ফার্মা এইড লিমিটেড।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ হিসাব বছর পর্যন্ত কোম্পানিটির মুনাফায় তেমন জৌলুস ছিল না। ২০১৪ হিসাব বছর থেকে কোম্পানিটির মুনাফায় জৌলুস শুরু হয়। ২০১৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির মুনাফা যেখানে ছিল শেয়ারপ্রতি ১.৩৮ টাকা, সেখানে ২০১৪ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৫.৩৮ টাকায়, যা ৩ গুণেরও বেশি। পরের বছর ২০১৫ সালে মুনাফায় আরও প্রবৃদ্ধির দেখা মিলে।

এ বছর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা দাঁড়ায় ৮.১৬ টাকা। তবে এর পরের বছর ২০১৬ হিসাব বছরে মুনাফায় কিছুটা ভাটা পড়ে। এ বছর শেয়ারপ্রতি মুনাফা দাঁড়ায় ৭.৫২ টাকা। কিন্তু ২০১৭ হিসাব বছরে কোম্পানিটির মুনাফায় আরও বড় উল্লম্ফন দেখা যায়। এ বছর শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৯.৪৮ টাকা, যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর সর্বোচ্চ।

অপরদিকে, চলতি হিসাব বছরের দুই প্রান্তিকে অর্থাৎ ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৭) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮.০৫ টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী হিসাব বছরের ১২ মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৯.৪৮ টাকার বিপরীতে চলতি হিসাব বছরের ৬ মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮.০৫ টাকা। মুনাফার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৯০ শতাংশ।

পক্ষান্তরে, ২০১৪ হিসাব বছর থেকে কোম্পানিটির রিজার্ভ তহবিলে বড় যোগান দেখা যায়। এ বছর হতে লভ্যাংশও বাড়তে থাকে। যদিও মুনাফার সাথে সামঞ্জস্য রেখে লভ্যাংশ বাড়েনি। ২০১৩ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ১.৩৯ টাকা মুনাফার বিপরীতে শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ দেয়া হয় ১.৫ টাকা। এ বছর লভ্যাংশ দিতে রিজার্ভের সাহায্য নেয়া হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ৫.৫৮ টাকা মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ দেয়া হয় ২.৫ টাকা।

এ বছর রিজার্ভে যায় শেয়ারপ্রতি ৩.০৮ টাকা। ২০১৫ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ৮.১৬ টাকা মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ দেয়া হয় ২.৫০ টাকা। এ বছর রিজার্ভে যায় শেয়ারপ্রতি ৫.৬৬ টাকা। ২০১৬ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ৭.৫২ টাকা মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ দেয়া হয় ৩.০০ টাকা। এ বছর রিজার্ভে যায় শেয়ারপ্রতি ৪.৫২ টাকা।

আর ২০১৭ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি ৯.৪৮ টাকা মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ দেয়া হয় ৩.৫ টাকা। এ বছর রিজার্ভে যায় শেয়ারপ্রতি ৫.৯৮ টাকা। এতে দেখা যায়, ৪ বছরে কোম্পানিটির রিজার্ভে গেছে শেয়ারপ্রতি ১৯.২৪ টাকা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির আস্থার হাতিয়ার। রিজার্ভ ফান্ড কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি মজবুত করে এবং কোম্পানিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সহযোগিতা করে। তবে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করে মাত্রাতিরিক্ত রিজার্ভ যুক্তিসঙ্গত নয়।’

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির রিজার্ভের মালিক শেয়ারহোল্ডার তথা বিনিয়োগকারীরা। কারণ প্রতি বছর মুনাফার একটা অংশই যা বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য ছিল সেটাই রিজার্ভ ফান্ডে জমা রাখা হয়।

বিনিয়োগকারীদের পাওনা অংশকে কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ডে জমা করে আপদকালীন ব্যয় মেটানোর পর এক সময় এই অর্থ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সমবণ্টন করে দেয়ার নিয়ম বহির্বিশ্বে চালু থাকলেও আমাদের দেশে এ নিয়মের অনুশিীলন খুব একটা দেখা যায় না। তবে অতিরিক্ত রিজার্ভ সময়ে সময়ে লভ্যাংশ হিসাবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বন্ঠন করে দেয়াই সমীচীন।

সর্বশেষ ২৮ ফেব্রæয়ারী ২০১৮ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ফার্মা এইডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে রয়েছে ২৪.২২ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৩.৩৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৭২.৪০ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, একাধিক কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর সুযোগ থাকার পরও তাদের মূলধনের পরিমাণ বাড়াচ্ছে না। রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য।

এ টাকা বিনিয়োগকারীদের দিয়ে দেয়া দরকার। প্রত্যেক দেশে এই টাকা বিনিয়োগকারীদের দেয়া হয়। আর আমাদের দেশে ফার্মা এইড সহ কিছু কিছু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তা লুটে পুটে খাচ্ছে।